গল্প লেখকঃ
khairunnesa Sultana
………………
এখন রাত সোয়া তিনটা! আজকে আবার তার চিৎকার শুনে ঘুম ভাঙলো নীলাঞ্জনার। …চোখ ভিজলো খানিকটা , একটু ব্যথা আর অস্বস্তি মিশ্রিত এক অনুভূতি। নীলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো,
রাতবিরেতের ঢাকা শহর নিরাপদ নয় বটে কিন্তু তাও নিজের এই অস্বস্তি কাটানোর জন্য জোৎস্নামাখা রাতের থেকে ভালো থ্যারাপি নীলের জানা নেই, তাই আগপিছ না ভেবেই বেড়িয়ে পড়া। সে যেন এক অদ্ভুত পথচলা! গতি নেই, গন্তব্য নেই, গন্তব্যে পৌছুনোর কোনো তাড়া নেই, শুধু আস্তে আস্তে হেটে চলা।
আচ্ছা রাতের বেলা নিয়ন বাতিগুলো কি অসাধারণ হয় দেখতে তাই না?? ছোট ছোট পোকাগুলোর সে বাতিতে বারবার বারি খাওয়া। আচ্ছা পোকাগুলার নামটা কি যেন? নামটা ঠিক মনে পড়ছেনা এখন নীলার।
হাটতে হাটতে সোজা ফ্লাইওভারের উপড়ে এসে দাড়িয়েছে এখন নীলা। এইবার বাড়ি ফিরা যাক ভাবতে না ভাবতেই সে দেখলো এক ছেলে রেলিংয়ের উপরে দাড়িয়ে আছে, হয়তো এখনি ঝাপ দিবে।
“পানিটা কিন্তু এখন খুব ঠান্ডা হবে “, ছেলেটির কাছে গিয়ে নীলা বল্লো। “দেখুন আমি আপনার সাথে রাত কাটতে চাই না, আপনি আসতে পারেন ধন্যবাদ ”
“বাব্বা! আপনি দেখি আমাকেই ভুল বুঝলেন, আমি ওইসব মেয়ে নই জনাব, আমি অর্নাস থার্ড ইয়ারে পড়ি, আমার নাম নীলাঞ্জনা। ”
“আমার নাম রেহান, আর আমি দুঃখিত, এত্তোরাতে এইখানে কোনো ভালো ঘরের মেয়ের দেখা পাওয়া যায় না, তাই ভাবলাম …, আমি লজ্জিত! ”
” আপনার নাম জেনে আর খুববেশি যে লাভ হবে তা আমার মনে হয় না।”
“এইকথা কেন বল্লেন? ”
“কারন কিছুক্ষণ পর সবাই আপনাকে লাশ বলবে হাহাহা, এইখানে থেকে ঝাপ দিলে কেও আপনার পরিচয় জানবেনা, শুধু একটি যুবক ছেলের লাশ হিসাবেই চিনবে। ”
কিছুক্ষণ চুপ থাকলো রেহান, তারপর খানিকটা রেগে বল্লো আপনি হেসে উড়িয়ে দিলেও আমি দিতে পারলাম না, কস্ট কি তা বুঝলে হয়তো এভাবে আমার কস্ট নিয়ে ঠাট্টা করতেন না, করতে পারতেন না! নীলাঞ্জনা বল্লো, ঠিক বলছেন ওইসব কস্ট টস্ট বুঝি না আমি, তা আপনার গল্প বলেন, দেখি কস্ট কেমন আপনার।
নীলার এই ধরনের রসিকতা রেহানের বিরক্তি ছাড়িয়ে যেতে লাগলো, কিন্তু তাও নিজেকে সামলে সে নিজের গল্প বলা শুরু করলো, গল্পের সারমর্ম কিছুটা এমন যে রেহান ভালো একজন ছাত্র, ভালো সন্তান, ভালো প্রেমিক, কিন্তু যে মেয়েকে সে ভালোবাসে সেই মেয়ে তাকে ছেড়ে চলে গেছে আর এই কস্ট রেহান মেনে নিতে পারছেনা. গল্প বলা শেষ! নীলাঞ্জনা এখনো বেশ হাস্যজ্জ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রেহানের দিকে। ব্যস! রেহানের সহ্যের সীমা এইবার শেষ, নীলাঞ্জনার চোখে চোখ রাঙিয়ে রেহান এইবার উঠার জন্য প্রস্তুত। নীলা রেহানের হাতটা ধড়লো, এই স্পর্শে রেহান বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো, নীলা তার হাতটা ধরে তাকে নিজের দিকে টানলো, নীলার পাশে এসে বসলো রেহান, নীলা রেহানের হাতটা তখনো শক্ত করে ধরে আছে।
রেহান হাতটা ছাড়াবে কিনা ভাবছে, কারন কোথাও না কোথাও তারও ভালো লাগছে পুরো ব্যপারটা, সে খানিকটা নিরাপদ মনে করতে লাগলো এইমেয়েটির আশেপাশে নিজেকে। জোৎস্নার রাত, ফ্লাইওভারের শুন্যতা, নিচে নদীর পানির শব্দ, সবমিলিয়ে অদ্ভুত সুন্দর সবকিছু!
নিস্তব্ধতা কাটিয়ে হঠাৎ নীলা বলতে শুরু করলো, “ওর হাতটা আমি সবসবসময় আরও অনেক শক্ত করে ধরে রাখতাম, ও এভাবে করে আমার হাতটা ধরতো যেন কখনো ছাড়বেনা, ফেসবুকে পরিচয়, বন্ধুত্ব, তারপর ভালোলাগা, কখন জানি ভালোবাসা হয়ে গেল, ভালোই যাচ্ছিলো সব, জানুয়ারির আঠাইশ তারিখ আমাদের প্রথম দেখা হয়, তারপর আট ফ্রেব্রুয়ারি আমরা ঘুরতে যাই, রিকশা করে শহর ঘুরে দেখার কথা ছিলো, সেদিন বাসায় গিয়ে দেখি ইনবক্সে মেসেজে লেখা ছিলো ভালোবাসি তোমাকে নীলা। খুশি ছিলাম অনেক, এরপর দিনের কোনো সময় ছিলোনা যখন কথা হতোনা, সারাদিন চ্যাটিং হতো, ভালবাসতে থাকলাম. আরও অনেক বেশি করে, এরপর প্রায়ই দেখা হতো, একদিন হঠাৎ ও ফোন করে বলে যে সব শেষ! আমাদের মাঝে নাকি সব শেষ, আমি ভয় পেয়ে গেলাম। দেখা করতেও রাজি ছিলোনা সে, শেষে ওর বাসার নিচে দাড়িয়ে থাকলাম, কিন্তু সে এলো না অনেক কস্টের পর দেখা করতে রাজি হলো ও।
সেদিন লাল একটা স্পোর্টস টিশার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্টেই বাড়ি থেকে বের হলো সে দেখেই বুঝতে পারলাম যে ঘুম থেকে উঠে আসছে। ঘুমঘুম চোখে ওকে দেখতে কি দারুন লাগছিলো! ফ্লাইওভারের উপরি দাড়িয়ে আমি ওকে দুর থেকে দেখেই চোখ থেকে পানি পড়তে থাকলো, ও সামনে এসে বলে, কাঁদো কেন??? আমি বল্লাম কি বলছো ফোনে এগুলা তুমি? আমি সত্যি মারা যাবো তোমাকে ছাড়া! এইবলে চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিলাম। ও হাসছে, আর বলে যে একটু মজা করছিলাম পাগলি. ওইটা আমি না আমার বন্ধু ছিলো. গলাটা চিনো কিনা দেখছিলাম, আমাদের গলা কিন্তু বেশ মিলে তাই না?? এই বলে হাসছিলো ও। আমার রাগ হচ্ছিলো প্রচন্ড এগুলা শুনে। কারন গত একটা রাত আমি কিভাবে কাটিয়েছি আমিই জানি! খুব মেজাজটা খারাপ হচ্ছিল, ইচ্ছে হচ্ছিলো ওকে মেরেই ফেলি, তাই কিছু না বলেই চলে আসতে চাইলাম ওখান থেকে, কিন্তু ও আটকাতে চাইলো, রাগে ওকে একটা ধাক্কা দিলাম আর ওমনি ও ট্রাকটার সামনে গিয়ে পড়লো। বিশ্বাস করেন আমি চাইনি এমনটা হোক, আমার সামনেই ও ছিটকে গিয়ে পড়লো ফ্লাইওভারের নিচে!” রেহান খেয়াল করলো নীলাঞ্জনার চোখ থেকে পানি পড়ছে, নীলাঞ্জনা চুপ করে বসে রইলো। নিস্তব্ধতা কাটিয়ে রেহান বল্লো আপনি কি তাকে এখনো ভালোবাসেন?? নীলাঞ্জনা একটু হাসলো আর বল্লো অনেক বেশি। রেহান নীলার হাতটা এইবার সরিয়ে বল্লো আপনার হাতটা বেশ ঠান্ডা। এত্তো ঠান্ডা হাত আগে ধরিনি আমি! নীলা বলে তুমি এর আগে কারও হাতই ধরোনি, আর যার জন্য মরতে এসেছো সেই মেয়েটি তোমাকে ভালোবাসে না, বিশ্বাস করো এমন কারও জন্য মরে তুমি শান্তি পাবেনা। রেহানের একটু অদ্ভুত লাগলো কথাগুলো শুনতে কিন্তু সে প্রতিবাদ করলো না। হঠাৎ সে বল্লো আচ্ছা সেই ছেলটির নাম কি ছিলো? রায়হান। তোমার নামের সাথে বেশ মিল আছে তাই না?
জ্বি তা ঠিক।
আচ্ছা অনেকরাত হলো এইবার বাড়ি ফিরে যাও,এত্তো রাতে এইখানে থাকতে নেই, জানো তো আজ পুর্নিমা? বাড়ি যাও, আর যা করতে এইখানে এসেছিলো তা করবে না কথা দিয়ে যাও।
জ্বি আচ্ছা, মানে কি বলবো আমি ..আচ্ছা নীলা তুমি এত্তো কিছু আমাকে কেন বলছো?
এমনিই, অনেকদিন কাওকে কিছু বলা হয় না তাই হয়তো। কেও আমাকে এত্তোটা কাছ থেকে দেখতে পারেনা আসলে। আচ্ছা রেহান এইবার বাড়ি যাও। বাড়ি অনেক দুরে, আর মা তোমার চিঠিটা পেয়ে কান্না করছে, ফিরে যাও এইবার।
“কিন্তু তুমি কেন বুঝতে পারছোনা নীলা আমার যে বেচে থাকার ইচ্ছা নেই আর ”
“আছে! বাড়িতে ফিরে গিয়ে একবার মার চেহারাটা দেখো এখন, বেচেঁ থাকার লুকানো ইচ্ছাটা জেগে উঠবে। আমারও উঠেছিল কিন্তু খুব দেরিতে তখন আর কিছু করার ছিলোনা।
এইবার রেহান সত্যিই অবাক হচ্ছে, মেয়েটিকে খানিকটা পাগল লাগতে শুরু করলো, সে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে চাইলো, বিদায় নিয়ে কিভাবে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে তাই এখন রেহানের একমাত্র চিন্তা।
“বেশ এইবার তাহলে উঠা যাক, ধন্যবাদ তোমাকে নীলা, তুমি না এলে হতো এত্তোক্ষনে অনেককিছু হয়ে যেত ..”
“কিছুই হতো না, কারন তুমি মরতে না, কারন কেও তোমাকে ধাক্কা দিতো না হাহাহা ..”
এই অদ্ভুত রসিকতা গুলো রেহানের মাথায় আর ঢুকছেনা …সে তাড়াতাড়ি বিদায় নিতে চাইলো ..
বিদায় নেয়াও ও শেষ রেহান বাড়ি ফিরে গেল, বাসায় গিয়ে দেখলো তার মা কাঁদছে, তাকে দেখে জড়িয়ে ধরে রাখলেন ..রেহান মার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে এইবার তার রুমে গেল, তার এখনো মাথা ঘুরছে, শেষ বার নীলার হাতটা খুব বেশি ঠান্ডা , রিহান ভাবতে থাকলো এই মেয়েটির মুখটা এত্তোটা চেনা কিভাবে লাগছিলো তার!
দুইদিন পর, সকালবেলা ..
রেহান খবরের কাগজটা হাতে নিয়েই চমকে গেলো! পেপারে একটি ছেলের ছবি, ছেলেটির ছবির সাইডে ছোট করে নীলার ছবি। রেহান এই ঘটনাটি আগেও পড়েছে, গতকাল নগরীর ফ্লাইওভার থেকে ছিটকে গিয়ে মৃত্যু । পুরো ঘটনাটি পড়তে গিয়ে রেহানের সব ঘটনা পরিষ্কার হতে লাগলো, একবছর আগে ঠিক একই দিনে মেহেরীন আলম নীলাঞ্জনা (নীলা) নামের একটি মেয়ের মৃত্যু হয়, কাকতালীয় ভাবে এই একই মেয়ের সাথে রায়হানের মানের মৃত যুবকটির ভালোবাসার সম্পর্ক ছিলো। মেয়েটির মৃত্যুর সময় সেখানে রায়হান উপস্থিত থাকায় পুলিশ তাকে সন্দেহ করেন কিন্তু প্রভাবশালী পিতার একমাত্র ছেলে হওয়ায় আর প্রমানের অভাবে তাকে কোনো প্রকার দোষে দোষী সাব্যস্ত করা যায় নি, নীলাঞ্জনার মা আফরোজা আলমের দাবি ছিলো যে তার মেয়ের মৃত্যু কোনো দুর্ঘটনা নয় বরং হত্যাকান্ড, কিন্তু আদালত প্রমাণের অভাবে তার এই দাবি খারিজ করে দেন ..আশ্চর্যজনক ভাবে এর পর থেকেই রায়হান রহমান নামের যুবকটি দাবি করেন যে নীলাঞ্জনা নামের মেয়েটি এখন তার সাথেই থাকে আর তিনি তাকে নিজের ঘরে দেখতে পান, এরপর তিনি স্বীকার করেন যে সেদিন যেটা হয়েছিলো তা দুর্ঘটনা ছিলোনা বরং তিনি ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিত ভাবে নীলাঞ্জনাকে গাড়ির সামনে ধাক্কা দেন, এই ঘটানার কারন হিসেবে তিনি বলেন যে তিনি নীলাকে ভালোবাসতেন না শুধু ভালোবাসার অভিনয় করেছিলেন কিন্তু নীলা তাকে সত্যি ভালোবেসে ফেলে, আর এই মিথ্যে সম্পর্কের ইতি তিনি এভাবেই পরিকল্পিত ভাবে শেষ করতে চেয়েছিলেন তাই সেদিন ছলনা করে নীলাঞ্জনাকে ফ্লাইওভারের উপর থেকে ফেলে দিয়ে পরবর্তীতে দুর্ঘটনার রুপ দেন ..তার এই মন্তব্য তার পিতা রহমান সাহেবের কথা ছিলো তার সন্তান নিজের প্রেমিকাকে হারিয়ে নিজের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে,আর এই মামলাটি এভাবেই বন্ধ হয়ে যায় …মামলা পুনরায় আবার উদঘাটন হয় যখন একবছর পর একইদিনে একই জায়গা থেকে একইভাবে রায়হান রহমানের মৃত্যুর ঘটনাটি উঠে আসে। …..
রেহান চুপচাপ বসে রইলো কিছুক্ষণ, ভাবছিলো নীলা মিথ্যা কেন বল্লো সেদিন যে, সে রায়হানকে মেরেছে। তারপর মনে পড়লো নীলার সেই কথা যে, সে রায়হানকে এখনো অনেকবেশী ভালবাসে।
০ Comments