লেখক:মোহাম্মদ আবু রায়হান রাকিব
…………………………
ভোরের আকাশে আলোর যে রেখাটা দেখা যায় সেটা এখনো দেখা যায়নি।
অস্পষ্ট কুয়াশা ভেদ করে একটি ছায়ামূর্তি এগিয়ে যাচ্ছে। তার হাটার ধরণকে দৌড় বলাটাই হয়ত শ্রেয়।
দৌড়টা শখের বশে নয়, অবাধ্য পাকস্থলীতে রোজ জেগে উঠা ক্ষুধাকে নিবারণ করার দৌড়। মূর্তিটার নাম রুবিনা,
গার্মেন্টস এ্রর একজন শ্রমিক হিসেবে কর্মরত। রুবিনার পায়ের গাড়িটা থামে বাস স্টেশনে। তার মতো আরো অসংখ্য রুবিনারা
দাঁড়িয়ে আছে যখন শহরের ভাগ্যবান মানুষেরা কম্বলের নিচে ঘুমে কাত।
একটা বাস আসে। ধাক্কাধাক্কির মাঝেও সে পৌঁছে বাসের দরজায়। একসময় উঠে পড়ে।
নাহ!!!আজও সিট পাওয়া গেলোনা কোনোমতে লোহার একটা হাতল ধরে দাড়িয়ে থাকলো। ভেতরে পুরুষরাও আছে। কেউ কেউ ইচ্ছা করেই গা ঘেষে রুবিনা তা বোঝে। কিন্তু ভ্রুক্ষেপ করেনা। সংগ্রামীদের হয়ত অনাকাঙখিত সত্য সহ্য করতে হয়।
রাতভর জ্বলতে থাকা সড়কবাতিগুলো ক্লান্ত। একটি একটি পেরিয়ে রুবিনা পৌছে যায় তার ফ্যাক্টরিতে।
রোবটের মত আরো অনেকের সাথে প্রবেশ করে কবুতরের খোপ এর মতো বিল্ডিং এর একটা অংশে।
দুপুর ২:০০ টা। খাওয়ার জন্য ১৫ মিনিট বিরতি। টিনশেড দেওয়া একটা জায়গায় খাওয়া দাওয়া সারতে হয়। আসার সময় সাবের মামার দোকান থেকে ৪টাকা দামের একটা পরটা চিনি দিয়ে পেচিয়ে এনেছে। খেতে রাবারের মতো হলেও রুবিনার জন্য এটাই লাঞ্চ।
টিনশেডটা তে আজ মনে হয় কেও আগুন ঢেলে দিয়েছে। যে আগুনটা লেগেছিলো আজ হতে ৬ বছর আগে। রুবিনা ভাবে আর ভাবে সে রাতটার কথা। আগুন কেড়ে নিয়েছিলো তার বাবা মা চাচী আর ছোট্ট ভাইটা কে।
জীবনের তাগিদে রুবিনা আসে ইট পাথরের শহরে। তারপর…?
নাহ!!!১৫ মিনিট শেষ রুবিনা আর ভাবতে চায়না। আবার কাজে যেতে হবে তাকে।
সন্ধ্যায় বের হয়ে আসে সে। আসার সময় ভ্যানগাড়ি থেকে কিনে নেয় লাউ। কোনোমতে আজ রাতটা কেটে যাবে ভাবে রুবিনা।
হাটতে থাকে। সকালের মতো ঝড়ের বেগে না। ধীরে ধীরে আহত মানুষের মতো খুড়িয়ে। আর ডান হাতে পলিথিনে তার রাতের জোগান। রাতে তাড়াতাড়ি খেয়েই শুয়ে পড়ে তার রুমে থাকা জামিলা আর মালেকার সাথে টুকটাক কথা সেরে।
পুরনো কাঁথাটার একটা গন্ধ আছে। রুবিনার পরিচিত সে মেটো গন্ধটা। কাঁথাটা মুখ পর্যন্ত টেনে চোখ বন্ধ করে সে।
রুবিনা ভাবে সামনের ঈদে একটা টুকটুকে লাল শাড়ি কিনবে সে। নীল পাড়ের শাড়ি!!
ঘুমে ডুব দেয় সে। স্বপ্নে হাজার রঙের প্রজাপতিরা আসে, আবার কেনো জানি হারিয়ে যায়।
আজ শুক্রবার। বন্ধের দিন। সপ্তাহ ধরে জমে থাকা কাপড়গুলো ধুয়ে নেয় সে। বিকেলে কোনো কাজ নেই তার।
কোথাও ঘুরতে গেলে মন্দ হয়না তো তাইনা? নিজেকে জিজ্ঞেস করে সে। নাহ!!! অতিরিক্ত খরচ। আবার মনে মনেই বাতিল করে ভাবনাটা।
০৭ তারিখ মঙ্গলবার ২১ এ রমজান। হ্যা আজ বেতন পাওয়ার কথা রয়েছে। চোখের কাজলটা আর খোপা বেধে রওয়ানা করে রুবিনা। মনে কেনো জানি একটা সুখের পায়রা উড়ছে। আজ তার কল্পনার লাল শাড়ি কিনবে। ঈদের সকালে লাল টুকটুকে লিপস্টিকের সাথে মিলিয়ে পড়বে। সারাদিন বান্ধবীদের বাসায় ঘুরাফেরা আর খাওয়া দাওয়া। মনের খাতায় সে হাজারো পরিকল্পনা আকেঁ। মনের অজান্তেই গুনগুন করে গান করে।
ফ্যাক্টরিতে যাওয়ার পর জানতে পারে আরো ৩ দিন পর বেতন দেওয়া হবে। রুবিনার মাথাটা হঠাৎ ভারী হয়ে আসে। আরো ৩ দিন অপেক্ষা। রুটিন বাধা ৩ দিন পর শনিবারে আবারো রুবিনা এক বুক আশা নিয়ে যায় ফ্যাক্টরীতে। নাহ! আজও দেওয়া হবে না। বাধ্য হয়ে সকল কর্মচারী ফ্যাক্টরির গেইটে জডো হয়। শ্লোগান দেয় কেউ কেউ।
বেশীক্ষন লাগেনা। মালিকপক্ষের নির্দেশে পুলিশ আসে। টিয়ারশেল ছুড়ে সাথে গরম পানি।
চারদিক ধোয়ায় আচ্ছন্ন। রুবিনা দৌড়াতে থাকে। সকালের দৌড়ের চেয়ে আরো দ্রুত।
কারণ জীবন রক্ষার জন্য সে দৌড়াচ্ছে। বেশীদূর যেতে পারেনা সে। হঠাৎ কি জানি একটা তার মাথার পেছন দিয়ে ঢুকে কপালটা ভেদ করে চলে যায়। চোখটা হঠাৎ ঝাপসা হয়ে আসে। লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। হাত দিয়ে দেখে কপালটা ভিজা।
হ্যা লাল রক্তে। লাল শাডিটার রঙ বুঝি তার কপালে লেগে আছে। বুঝেনা রুবিনা। বুঝতেও চায় না। অজান্তে একটু হাসে।
চোখের কোণ কেনো যেনো ভিজে উঠছে। তারপর প্রশান্তির ঘুমে ঢলে পড়ে !!!
পরদিন সকালের সংবাদপত্রে শিরোণাম আসে…
“””চট্রগ্রামের পোশাক কারখানার বকেয়া বেতনের দাবীতে শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ,নিহত ১”””
সংবাদ পত্রে সে লোহার বুলেট টার কথা লিখা হয়না যেটা রুবিনার লালশাড়ির রঙকে শকুনের মতো খামচে দিয়েছিলো।
রুবিনা আবারো আসবে হয়ত লোহার গেইট টা তে। মানুষ হিসেবে নয়।
ভূতুড়ে আত্মার রুপে।
০ Comments