লেখা- ফারজুল ইসলাম অভয়
– ‘নাহ, পালাতেই হবে। তা নাহলে তাসফিকে হারাতে হবে। যাকে জীবনের থেকে বেশি ভালোবাসি তাকে ব্যতীত বেঁচে থাকা কি আদৌ সম্ভব? উহু, পালিয়েই বিয়ে করব। [মনে মনে]
তাসফি অবশ্য এর আগে আমাকে বেশ কয়েকবার বলেছিল, যেন তাকে নিয়ে পালিয়ে যাই। নয়তো তাকে হারাতে হবে। আমি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছিলাম। তাই সেদিকে আর আগানো হয়নি। কিন্তু নাহ, তাকে ব্যতীত এই অভয়ের বেঁচে থাকা কিছুতেই কল্পনা করতে পারছি না। তাসফি ফোন দিই, দেখি সে কী বলে।
ফোন ধরছে না তাসফি। ঘুমাচ্ছে হয়তো। একের পর এক ফোন দেবার পর ২৩ নম্বর কলটিতে সে ফোন রিসিভ করলো-
→ এই তুমি তো ঘুমাতে বলে ফোন রেখে দিলা, এখন এত রাতে আবার ফোন দিচ্ছো কেন?
ঘুমের ঘোড়ে বিরক্তি একটা ভাব ছিল তার কথার মাঝে।
→ শুনো, গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলব। তুমি একটু কষ্ট করে ওয়াশরুমে গিয়ে মুখে পানি দিয়ে এসো।
→’না, লাগবে না পানি দিতে। তুমি বলো আমি শুনছি।‘ এখনও বিরক্তি নিয়েই কথাটা বলল তাসফি।
→ওকে, তাহলে শুনো। তুমি এখনি তোমার কাপড়চোপড় সব গুছিয়ে নাও। আমরা আজ ভোরে পালাব।
→ ‘What! কী বলছো তুমি? হঠাৎ এ সিদ্ধান্ত? তোমাকে তো আমি সেই কতদিন থেকেই বলে আসছি। তুমিই আমাকে বার বার ফিরিয়ে দিয়েছো। আর আজ হঠাৎ কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই তুমি বলছো পালিয়ে যাবা?’ – কিছুটা অবাক ও সন্দেহ নিয়েই কথাগুলো বলল ও।
→ হ্যাঁ, অনেক ভেবেছি। তোমাকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকাটা নিরর্থক। তোমাকে ছাড়া আমি কিছুই কল্পনা করতে পারছি না। প্লিজ তুমি না করিও না। আর হ্যাঁ, যদি পারো তাহলে টাকা-পয়সা যা আছে সাথে নিও। আমার কাছেও খুব বেশি টাকা নেই।
→ আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু…..! [কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে]
→ ‘বুঝতে পারছি, বাবা-মায়ের কথা ভাবছো তো? ও কিছু হবে না। হয়তো একটু কষ্ট পাবে। পড়ে ঠিকই মেনে নিবে। বাবা-মায়েরা সন্তানদের কখনও ফিরিয়ে দিতে পারে না।’
→ ‘হুম ঠিক আছে। আমি কখন বের হবো? কোথায় যেতে হবে?’
→ ‘তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। তুমি শুধু রেডি হয়ে থাকবা। ফজরের ঠিক পর পরই আমি তোমাকে তোমার বাসার সামনে থেকে নিয়ে আসবো। তুমি এখনি সব রেডি করো। এখন রাখছি তাহলে।’
আমাদের সম্পর্কটা দুই বছরের। আমরা প্রায় সমবয়সী। দু’জন দু’জনাকে অনেক বেশি ভালোবাসি। কিন্তু ওর পরিবার থেকে বেশ কিছুদিন যাবত বিয়ের জন্য অনেক চাপ দিচ্ছিলো। এমনকি একটি ছেলের সাথে বিয়ে প্রায় ঠিকঠাকই বলা চলে। শুধু বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করা বাকি। অপরদিকে আমি এখনও গ্রাজুয়েশনই শেষ করতে পারিনি। সেজন্য আমি নিজের ও তার বাবা-মায়ের কাছে আমাদের সম্পর্কের কথাটা বলার সাহস পাচ্ছি না। তাই এ কঠিন সিদ্ধান্তটি নেওয়া।
যত যাই হোক, পরিবারের একজনকে অবশ্যই এটা জানাতে হবে। নয়তাে কী না কী করে বসে। পরিবারের মধ্যে মা ও আপুর সাথে খুব ভালো সম্পর্ক আমার। কিন্তু মাকে তো এটা বলাই যাবে না। এক কাজ করি, আপুকে তো এত রাতে ফোন দেওয়া যাবে না। একটা টেক্স ম্যাসেজ দিয়ে রাখি।
‘আপু, তুই তো তাসফি আর আমার সম্পর্কের কথা জানিস। ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তাই আর কোন উপায় না পেয়ে আমরা আজ পালিয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিছি। মাফ করে দিস বোন। বাবা-মা হয়তো অনেক কষ্ট পাবে। কিন্তু করার কিছু নাই, তুই তো সব জানিস। ভালো থাকিস, আর আমাদের জন্য দোয়া করিস।’
গভীর রাত। অর্ধেক পৃথিবীর মানুষ যেখানে ঘুমে বিভোর, আমি সেখানে পালিয়ে বিয়ে করার প্লানিংয়ে বিভোর। সব প্লান সেট করে সবচেয়ে প্রিয় ও কাছের বন্ধু ইমরানকে বিস্তারিত টেক্স করে দিলাম। বিপদের সময় যাতে ওর শরণাপন্ন হতে পারি। চোখটা লেগে আসছে, তারপরও ঘুমানোটা ঠিক হবে না। সঠিক সময়ে যদি উঠতে না পারি! তাই নিজের যাবতীয় সবকিছু গুছিয়ে নিতে নিতেই সময় পার করে দিলাম।
ফজরের নামাজ আদায় করেই বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম। তাসফির বাসার সামনে গিয়ে ফোন করতেই ও চুপিসারে বের হয়ে এলো। রাতেই একটি টেক্সি ভাড়া করে রেখেছিলাম। রওনা দিলাম এক অজানা ঠিকানায়। তাসফির মাথা আমার বুকে। এক বুক বিশ্বাস ও ভালোবাসা নিয়ে আজ ও আমার বুকে ঠাঁই নিয়েছে। রাতে ঘুমায়নি তাই অল্প সময়ের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমারও খুব ঘুম পাচ্ছে। কখন যে আমিও ঘুমে বিভোর হয়ে গেলাম বুঝতে পারিনি।
“মা দাঁতে দাঁত চেপে প্রচন্ড ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। প্রসব যন্ত্রণা যে কতটা ভয়াবহ তা শুধুমাত্র গর্ভবতী মায়েরাই উপলব্ধি করতে পারেন। অবশেষে জন্ম হলো এক ফুটফুটে ছেলে সন্তানের। সন্তানকে কাছে পেয়ে একটু আগের হাজারো যন্ত্রণা যেন নিমিষেই পানি হয়ে গেলো। বুকে নিয়ে পরম স্বযত্নে আদর করতে লাগলেন। শুরু হলো সন্তান পালনের নতুন এক যুদ্ধ। যখন-তখন মল-মূত্র ত্যাগ, বমি আরো কত কী! উহু, তার কপালে এতটুকুও বিরক্তির ছাপ নেই। বরং পরম যত্ন ও আনন্দের সহিত সব পরিষ্কার করে বুকভরা ভালোবাসা দিয়ে কাছে টেনে নেন তিনি।
সামান্য জ্বর আমার। অর্ধেক পৃথিবী যখন ঘুমে বিভোর, মা তখন আমার সেবায় নিয়োজিত। কতোশত রাত এভাবে পাড়ি দিয়েছেন কে জানে!
বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে গভীর রাতে বাসায় ফিরেছি। মা তখনো খাবার টেবিলে খাবার সামনে রেখে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন।
সকালে ঘুম থেকে বাবাকে পেতাম না। ফজরের ওয়াক্ত শেষ করেই জীবিকার তাগিদে সারাটা দিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর রাতে বাসায় ফিরতেন। মুখে ক্লান্তির কোনো আভাস নেই। বাবাকে কখনো অসুস্থ হতে দেখিনি। আসলে বাবাদের অসুস্থ হতে নেই। যত ঝড়, বৃষ্টি, প্রতিবন্ধকতাই থাকুক না কেন! তিনি জীবিকার তাগিদে বেড়িয়ে গেছেন। ‘বাবা আমার এটা চাই, ওটা চাই’ কতোশত আবদার করছি। বিরক্তি নয়, বরং মুচকি হাসির আদলে আশ্বস্ত করেছেন। কষ্ট করে হলেও সব আবদার পূরণ করেছেন।”
ঘুম থেকে চমকে উঠলাম। স্বপ্নে এসব কী দেখলাম আমি! যে বাবা-মা আমাদের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করেছে। শত কষ্টের মাঝেও পরম ভালোবাসায় ছায়া হয়ে পাশে ছিলো, তাদেরকে এত বড় ধোঁকা দিতে চলছি আমরা?
হঠাৎ ফোনে কল বেজে উঠলো। আপু কল করেছে। কল রিসিভ করতেই ওপাশ হতে কান্নার শব্দ। আপু কান্না করছে। “ভাই ও ভাই, কই তুই? এমন করলি কেন তুই? তুই জানিস না? তোকে নিয়ে আমরা সবাই কতোশত স্বপ্ন বুনে রেখেছি। তুই জানিস না তোকে আমরা কতটা ভালোবাসি? তুই জানিস না? মা তোকে ছাড়া একটা রাতও থাকতে পারে না। প্লিজ ভাই তোর কাছে হাত জোড় করছি। তুই এমন কিছু করিস না। ফিরে আয়।”
চোখ দিয়ে অনরগল পানি ঝড়ছে আমার। কথা বের হচ্ছিল না মুখ থেকে। কিছু না বলেই লাইনটা কেটে দিলাম।
একটু পরেই ভাইয়ার কল। প্রবাসে থাকেন তিনি। কল রিসিভ করতেই অতি উৎসাহী হয়ে বলতে থাকলেন-
→”কিরে অভয় কেমন আছিস? ভাইকে তো ভুলেও একটু স্মরণ করিস না। শোন, তোর জন্য একটা সুখবর আছে।”
→ ‘কী সুখবর?’
→ ‘তোর মনে আছে? তুই যখন এইচ এস সি তে ভালো রেজাল্ট করছিলি তখন তুই আমার কাছে একটা দামি ল্যাপটপ আবদার করছিলি। তখন তো দেবার মতো সামর্থ্য ছিল না। তবে তোর আবদারের কথা ভুলে যাইনিরে। আমি নির্ধারিত সময়ের পরও অতিরিক্ত কাজ করে অল্প অল্প করে টাকা জমিয়েছিলাম তোর জন্য ল্যাপটপ কিনব বলে। আজ তোর জন্য দামি একটা ল্যাপটপ কিনছি ভাই। কালই পাঠিয়ে দিবো। তবে ভালো করে লেখাপড়া করবি কিন্তু। অনেক বড় হতে হবে তোকে। আর বাবা মাকে দেখে রাখবি, আমি তো দূরে তাই তাদেরকে সেবা করার সুযোগ পাই না। তুই তো কাছে আছিস। তাদের যেন কোনো রকম কষ্ট না হয়। এমনিতেই অনেক কষ্ট করে আমাদের লালন-পালন করছেন তারা।”
এবারও কথা বলতে পারলাম না। ফোনটা কেটে দিলাম। চিৎকার দিয়ে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। কী ভুল করতে চলছি আমি! এত আদর, স্নেহ, ভালোবাসা উপেক্ষা করে আমি কীভাবে এমন গর্হিত একটি সিদ্ধান্ত নিলাম?
ড্রাইভারকে গাড়ি ব্যাক করতে বললাম। তাসফি একটু অবাক হলো। তাকে সবকিছু বুঝিয়ে বললাম। এবং সিদ্ধান্ত নিলাম তাকে নিয়েই আমাদের বাসায় ফিরবো।
বাসায় ফিরে দেখি মা আমার রুমে গিয়ে হাউমাউ করে কান্না করছে। বাবা নিস্তব্ধ হয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। আমাকে ও তাসফিকে দেখে যেন দুজনই চমকে উঠলেন।
আমি গিয়ে সরাসরি মায়ের পায়ে পড়ে কান্না করতে থাকি। মাও আমাকে জড়িয়ে খুব কান্না করতে থাকে। বাবা তখনো নিস্তব্ধ। আসলে তারা ভেবেছে আমি তাসফিকে বিয়ে করেই ফেলেছি।
তারপর বাবা-মা দুজনকে একসাথে বসিয়ে তাসফিকে তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই এবং সবকিছু খুলে বলি। তাদেরকে বলি তাসফির বাবা-মাকে খবর পাঠিয়ে আমাদের বাসায় নিয়ে আসতে। এরপর আপনারা যে সিদ্ধান্ত নিবেন আমরা দুজন সে সিদ্ধান্তই মেনে নিব।
এরপর তাসফির বাবা-মাকে সংবাদ পাঠিয়ে আনা হয়। তারা আসার পর তাসফিও তার মাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্না করে। পরে তার বাবা মাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলি আমরা দুজন। আমাদের এ সিদ্ধান্তে তারাও অনেক খুশি হয়েছে।
তারপর দুই পরিবার মিলে সিদ্ধান্ত নেন যে, আমাদের দুজনের পড়ালেখা শেষ হলে এবং আমি ভালো একটি চাকরিতে জয়েন করার পর দুই পরিবারের উপস্থিতিতে আমাদের বিয়ে দিবেন। আমরাও নিশ্চিন্তে মন দিয়ে পড়ালেখা শুরু করে দিলাম।
আসলে আমাদের বাবা-মায়েরা যে কতটা ভালোবাসেন তা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। আমরা ২-৩ বছরের ভালোবাসার জন্য বাবা-মায়ের সারাজীবনের অকৃত্রিম ভালোবাসা উপেক্ষা করে থাকি। এটাও ভুলে যাই যে, বাবা মায়ের অবাধ্য হয়ে কিছু করলে জীবনে সুখী হওয়া যায় না। তাই বাবা-মাকে কখনও কষ্ট দিবেন না। সবসময় সবকিছুর ঊর্ধ্বে বাবা-মাকে রাখার চেষ্টা করবেন। তাদের ছায়াতলে ইহকালেও যেমন নিরাপদে থাকবেন পরকালেও পাবেন চির সুখের জান্নাত, ইনশাল্লাহ।
বাহ..!!
অভয় ভাইয়ার ভালোবাসার কাহিনী পড়লাম।
সত্যিই কোনো কাজ করার আগে ভাবতে হয়।
বাবা মা কতো কষ্ট করে বড় করেছেন আর দু’দিনের ভালোবাসায় পাগল হয়ে তাদেরকে ভুলে যাই।
আল্লাহ সকল সন্তানদের বুঝার তৌফিক দান করুক।
যাবত–যাবৎ
প্লান–প্ল্যান
ঘোড়ে-ঘোরে
শুনো-শোনো
বলব-বলবো(যেহেতু তুমি বলেছে)
শুনো-শোনো
পালাব-পালাবো
পড়ে-পরে
হুম-হ্যাঁ
যাই হোক-যাইহোক
কতোশত-কত শত
যাইনিরে-যাইনি রে
বাহ্ বেশ ভালো লিখেছেন। গল্পটা মাঝে একটা শিক্ষামূলক দিক ফুটে উঠেছে, যে প্রেমিকার প্রতি ভালোবাসা যতই হোক বাবা-মার ভালোবাসার কাছে তুচ্ছ।যদিও অভয় স্বপ্ন দেখে তা বুঝতে পেরেছে। যাইহোক মাঝখানে মনে হয় কাহিনী কিছুটা গুলিয়ে ফেলেছেন। তবে পড়ে ভালোই লেগেছে আর বানানের দিকে আগামীতে খেয়াল রাখবেন আশা করি। অনেক অনেক শুভ কামনা রইল।
আপনার গল্পটা পড়ে আমার চোখে পানি এসে গেল। আসলেই বাবা মায়ের উপরে শ্রেষ্ঠ কিছুই হয় না। কত কষ্ট করে মেহনত করে মাথার ঘাম পায়ে ঝড়িয়ে তারা আমাদের বড় করেন, বিনিময়ে আমরা তাদের কী দেই? শুধু কষ্ট আর কষ্ট।
দুই তিন বছরের দীর্ঘ সম্পর্কগুলোতে তারা এতোটাই বিশ্বাসী হয়ে উঠে যে একসময় তাদের কাছে বাবা মায়ের কষ্টটাও ফিকে মনে হয়, তাদের ভালোবাসাও তুচ্ছ মনে হয়। অভয় এমনই একটা ভুল করতে যাচ্ছিল, তবে সে সময় থাকতেই শুধরে গেছে ও বাবা মায়ের কাছে ফিরে গেছে।
টেক্স- টেক্সট।
অনরগল- অনর্গল।
শুভ কামনা।