লেখাঃ অনুষ্কা সাহা ঋতু
.
.
নিস্তব্ধ প্রকৃতি ভারী বাতাস বুকে বয়ে বেড়াচ্ছে যেন। মাথার ওপর গনগনে সূর্যের মৃদুতাপেও দরদর করে ঘাম ঝরছে। পুকুরগুলো ইতিমধ্যেই শুকিয়ে মরুভূমি হয়েছে। তবে দু’একটা তেঁতুলতলার পুকুরে তখনও ঠাণ্ডা জলের ঢের। কার বাড়ির সামনে যেন চারজন বিহারীর ছেলে, দু’জন আলবদর সমেত দাঁড়িয়ে আছে। ৮মাসের বাচ্চা কোলে দাঁড়িয়ে মহিলাটা কেঁদেই চলেছে কী যেন বলছে, মিনতি করছে। অথচ, ওরা কালো শাড়ি পরা মেয়েটাকে টেনে নিয়ে চলে গেল।
.
১৯৭১ সালের ১৪ই জুলাই দিনটা। পটিয়া থানার চক্রশালা অঞ্চলে, কমল মুন্সির হাট নামক জায়গাটার প্রায় ৯০শতাংশ পরিবার পালিয়েছে। কেউ কেউ তখনও পালানোর উপক্রম
করছে। মিলিটারি আসার আগে যে করেই হোক পালাতেই হবে। বেঁচে থাকলে ভিটেবাড়ি আবার পাওয়া যাবে কিন্তু জীবন তো একটাই।
.
মিলন দে’র সদ্য বিধবা স্ত্রী তুলসী, পতি বিয়োগের শোকটাও ঠিকমতো পালন করতে পারল না। মেয়ে দু’টোকে নিয়ে গাঁট বাঁধতে হল।
তুলসী দেবীর বড় মেয়ে আরতি। অসম্ভব রূপবতী মেয়েটি এই সবে ১৭পার করে ১৮তে পড়লো। ছোট টা লিলু, এখনও দুধের শিশু।
.
রাতেই পোটলাগুলো গুছিয়ে রাখল তুলসী। রাতের আঁধারে বাচ্চা নিয়ে পথ হাতড়ানো অসম্ভব, সকালের আলোতেই বের হতে হবে। সকালের অপেক্ষায় কাকভোর হয়ে এলে আরতিও স্নানের জন্য পুকুরঘাটে এগিয়ে গেল। অনেকদিনের অভ্যাস, না জানি আবার কবে এই পুকুরে পা ডোবানো হবে।
.
খেজুর পাতায় ঘেরা দেওয়া পর্দার আড়ালে ভেজা শাড়ি পাল্টে নেয় আরতি। একে একে কালো রঙের ব্লাউজ, পরনের নীল শাড়ি খুলে সন্তর্পণে গা মুছে শুকনো বস্ত্র ধারণ করে। বিহারীর ছেলেরা সেই পথ দিয়েই যাচ্ছিল। শকুনের চোখ থেকে কী আর শিকার লুকোনো যায়! লোভাতুর দৃষ্টি আরতির শরীরের ভাঁজেই আটকে রইল।
.
৪জন বিহারি আর ২জন রাজাকার বাহিরেই দাঁড়িয়ে ছিল, আরতির বের হওয়ার অপেক্ষায় হয়ত। বের হতেই দু’একটা অশ্রাব্য উক্তি করে আরতির সদ্য পরিহিত কালো রঙের শাড়ির আঁচল ধরে টান দিল। দু’হাতে বুকের কাপড় আঁকড়ে প্রাণপণে চেষ্টা করতে থাকে আরতি লাজ বাঁচানোর। যদিও চিৎকার করে কোনো লাভ নেই, তবুও গলা ছেড়ে চিৎকার দিল আরতি।
তুলসী দৌড়ে বের হল লিলুকে কোলে নিয়ে। তখন শকুনগুলো আরতিকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলেছে।
.
“ওরে ছাইড়া দাও….ওর দুধের শিশুটা মা ছাড়া মইরা যাইবো। ও রে আরতি, তোর মাইয়ারে এট্টুখানি দুধ দিয়া যা…ছাইড়া দাও ওরে…”
বড় মেয়েকে বাঁচানোর তাগিদে কোলের মেয়েকে আরতির মেয়ের পরিচয় দিলো। শকুনের কানে কি ভালো কথা রোচে? নিষ্কৃতি পায়নি আরতি।
.
আলবদর দলের ছেলে দু’টো আরতির জ্যাঠাতো ভাইয়ের বন্ধু। কতবার তো এসেছে জ্যাঠার ঘরে,অথচ তখনও আরতিকে তারা খারাপ নজরে দেখেনি। এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে সেটা হয়ত কল্পনাতেও আসেনি আরতির। মিলন দে’র ভাগ্যলক্ষ্মী অবশেষে সম্ভ্রম হারালো নিজের দেশের হাতেই।
সম্ভ্রম হারিয়ে আরতি আর বেঁচে থাকার সাহস করতে পারল না। অসম্ভব লজ্জা আর ঘৃণায় চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে আরতির। ব্যথায় পা মাটিতে রাখা অসম্ভব মনে হচ্ছে। শতছিন্ন শরীরটাকে কোনোমতে টেনে হিঁচড়ে মাটির ছাদে উঠে গেল। ছাদের কোণে রাখা ধানের ওষুধ খেয়েই লজ্জা থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে দিল নিজেকে,চিরতরে। কিন্তু, ঠোঁটের কোণে প্রবল ঘৃণা স্পষ্ট ফুটে ছিল।
.
মিলন দে’র কষ্টে বানানো ঘরেই বিবস্ত্র করা হয়েছিল তার মেয়েকে। পুরো ঘটনার সাক্ষী ছিল ঘরের নির্জীব আসবাব। উপরে যিনি বসে আছেন উনি দেখেছেন কি না জানা নেই, তবে আরতির আদরের সবুজচোখা কাঠপুতুলটাই ছিল সবচেয়ে বড় সাক্ষী।
.
৯মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নিহত পাক সৈন্যদের মধ্যে ঐ ৬জনের ৫জনই শেষ হয়ে গেছে। আলবদর দলের একজন বেঁচে ছিল কেবল। ওর ভাগ্যে হয়তো অন্য কিছু অপেক্ষা করছিল।
.
মীর কাশেমের বিশাল সাম্রাজ্যে একটা মাত্র রাজকন্যা। শেষ বয়সে সন্তান প্রাপ্তিতে যেন পুরো পৃথিবীর সুখ পেয়েছে মীর কাশেম। বড় আদরের মেয়ে শ্রেষ্ঠা। রূপে, গুণে, ব্যবহারে সত্যিই সে সর্বশ্রেষ্ঠ।
.
আজ ১৪ই জুলাই,
হুরের ন্যায় দেখতে শ্রেষ্ঠার আজ ১৭বছর পূর্ণ হলো। লম্বা চওড়া সুগঠিত শরীর, উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণ, ভ্রুযুগল যেন তুলিতে আঁকা। কোঁকড়ানো কাজল কালো চুলের গোছা কোমড় ছাড়িয়ে গেছে আর বাম ওষ্ঠের নিচে ছোট্ট একটা তিল যেন সৌন্দর্যকেও ঈর্ষান্বিত করে তোলে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, মেয়ের দিকে তাকালেই মীর কাশেমের অস্বস্তি হয়। কীসের যেন অপরাধবোধ জেগে ওঠে।
.
জন্মদিন উপলক্ষে বাড়িতে এলাহি কাণ্ড বাঁধিয়েছেন মীর কাশেম। দামী সব উপহারে ঘর ভরে গেছে। অনুষ্ঠান শেষে সবাই শুয়ে পড়লে শ্রেষ্ঠা উপহার খুলতে বসল। দামী চকচকে মোড়কের ভীড়ে হঠাৎ তার মনোযোগ কেড়ে নিল মলিন হলুদ কাগজে মোড়া একটা মাঝারি বাক্স। সব ফেলে সেটা নিয়েই বসল ও। ওতে একটা কাঠের পুতুল রয়েছে।
.
আচ্ছন্নের মতো পুতুলটার দিকে তাকিয়ে রইল শ্রেষ্ঠা। কী সুন্দর দেখতে পুতুলটা!জরির কাজের কাপড় কেটে হাতে বানানো শার্ট, সবুজ রঙের একটা প্যান্ট তাই হাতে সেলানো। সবচেয়ে সুন্দর পুতুলের চোখগুলো,সবুজ সবুজ। মনে হচ্ছে পুতুলটা যেন ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
.
সেদিনের দুঃস্বপ্নটা আবার দেখেছে মীর কাশেম। এসির মধ্যেও ঘাম দিচ্ছে। হঠাৎ ঠকঠক একটা শব্দে লাফ দিয়ে উঠে বসল। মনে হচ্ছে কড়িডোরের মেঝেতে কেউ লাঠি দিয়ে ক্রমাগত ঠুকছে।
শব্দটা মনে হল তার ঘর পার করে সামনের দিকে গেল।
.
বেশিরভাগ বাড়ির কড়িডোরে হালকা আলো জ্বালানো থাকে। এখানেও তার অন্যথা না। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মীর কাশেম। ধীর কদমে দরজা খুলে বেরিয়ে এল।
.
আবছা আলোতে দেখল কড়িডোরের শেষ মাথায় কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। কোনো মেয়েই হবে। কাজের লোক হওয়ার আশংকা নেই কারণ, দোতালায় কাজের লোকের ওঠা বারণ। মেয়ে বলতে আছেই কেবল শ্রেষ্ঠার মা নুরজাহান বেগম, যিনি ঘুমে আর শ্রেষ্ঠা নিজে। তবে এটা বোধ হয় শ্রেষ্ঠা।
.
মেয়েটার যখন যেটা ইচ্ছে হয় সেটাই করে। হিল পড়ে হাঁটছিলো হয়তো তাই অমন শব্দ হয়েছে। ওমা! আবার শাড়িও পরেছে। মেয়েটা না! পাগলি একটা। মীর কাশেম মৃদু হেসে শ্রেষ্ঠার পিঠে স্পর্শ করে বলে,
-” আজ আবার শাড়ি পরার ইচ্ছে হয়েছে বুঝি পাগলিটার! সকালে পড়লে কী হতো! আচ্ছা, এখন আমার দিকে তাকা তো দেখি, আমার রাজকন্যাকে কেমন দেখাচ্ছে!”
.
মেয়ে ঘুরে তাকাতেই মীর কাশেম দু’হাত পিছিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো। এটা তো তার মেয়ে নয়! অসম্ভব রূপবতী যে মেয়েটা শ্রেষ্ঠা বেশে দাঁড়িয়ে আছে সে অন্য কেউ। সবুজাভ চোখে যেন আগুন জ্বলছে, ঠোঁটে ঘৃণার বলিরেখা, মুখমণ্ডলের প্রতিশোধের ছাপ। কিন্তু হাত পাগুলো কাঠের কেন?
.
সকালে নিত্যদিনের মতো স্বামীকে জাগাতে গিয়ে দেখে বিছানার অপর পাশটা খালি। বাথরুমেও কেউ নেই। দরজা খুলে বেরিয়ে এলো নুরজাহান বেগম। ঘুম ঘুম চোখে সামনের দিকে আগাতে গিয়ে কিসে যেন পা আটকে যায়। চোখ খুলেই দেখে কড়িডোরে ছিন্ন বস্ত্রে নিথরভাবে পড়ে আছে তার স্বামী। হাতের মুঠোই কেবল একটা কালো ব্লাউজের টুকরো সাথে একটা বোতাম।
.
ঘুম পুরোপুরি ভাঙলেও শ্রেষ্ঠার সারা শরীর ব্যথায় অবশের মতো হয়ে রয়েছে। কোনোমতে উঠে বসলো। পুতুলটা নিয়ে বেশ উৎসাহিত সে। ঘুমই হচ্ছিল না কখন যে বাবাকে দেখাবে এই ভেবে। কিন্তু পুরো ঘর খুঁজেও পুতুলটা আর পাওয়া গেলো না। কেবল খালি বাক্সটাতে ছোট একটুকরো কালো শাড়ির অংশ পড়ে ছিল।
.
কেউ না জানলেও সেই রাতটাই সাক্ষী, অন্যদের মতো রাজাকার মীর কাশেমও নিজের কৃতকর্মের শাস্তি পেয়েছে। হয়তো মীর কাশেমের মতো বহু ধর্ষক রাজাকারদের শাস্তি দিতে কোনো না কোনো রাতে আরতি ফিরে এসেছিল কাঠপুতুল হয়ে। কে জানে!
পূনর্জন্ম
জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...
অসাধারণ লিখেছেন।
মনোমুগ্ধকর গল্প।
আরতির মতো এভাবেই ১৯৭১ সালে মীর কাশেমের হাতে ধর্ষণ হতে হয়েছিলো।
তারা এ জীবনে রেহাই পেলেও পরকালে পাবে না।
তবে আরতি কাশেমকে শেষ করতে পেরেছে।
প্রতিশোধ নিতে পেরেছে।
পোটলাগুলো-ব্যাগগুলো (পোটলা মনে হয় আঞ্চলিক ভাষা আর এইখানে শুদ্ধ ভাষা ব্যবহার হয়েছে)
হয়ত-হয়তো(দুই জায়গাতে একই ভুল)
ভীড়ে-ভিড়ে
ওঠা-উঠা
বাহ্ বেশ ভালো লিখেছেন। গল্পটা প্রথমে বাস্তব চিত্র থাকলেও শেষের দিকে কেমন জানে বেমানান হয়ে গেছে। কাঠপুতুল মানে ভূত হয়ে কেউ কাউকে হত্যার করতে পারে। যদিও পুরোটা শুরু থেকে বাস্তব চিত্র বাদ দিয়ে ভূতের গল্প সাজিয়ে লিখতেন তাহলে মিলতো। কিন্তু বাস্তবের সাথে ভূত কিংবা কাঠপুতুল মানুষকে মারতে পারবে কখনো মিলবে না। কারণ ভূত বলতে বাস্তবে কিছু নেই। যা আছে তা কল্পনা। আসলে প্রাচীনকালে মানুষের গুহাতে বসবাসের সময় নিজে ছায়াকে দেখে ভয় পেতো আর সেই থেকে ভূত শব্দ তৈরি। তবে শয়তান অবশ্যই আছে আমাদের পাশে। কারণ তা কুরআনে উল্লেখ আছে। কিন্তু ভূত কোথাও নেই। যাইহোক ভালো লিখেছেন, পড়েও অনেক ভালো লেগেছে । শুভ কামনা রইল।
প্রথমত যে ব্যাপারটি আমাকে মুগ্ধ করেছে তা হলো লেখনশৈলী। প্রতিটি লাইন এতো চমৎকারভভাবে সাজানো যে আমি বিভোর হয়ে পড়ছিলাম।
১৯৭১ সালে সেই পশুগুলোর অত্যাচার অকথ্য। একটা মেয়ের কাছে তার সম্মান প্রাণের চেয়েও বড়, কিন্তু যখন কিছু পশুদের হাতে নিকৃষ্টভাবে এ সম্মানে আঁচ লাগে, তখন এ আঘাত সহ্য করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। আর তাই আরতি কষ্ট অপমান সইতে না পেরে নিজেকে বিলীন করে দেয়।
তবে মীর কাশেম তার শাস্তি পেয়েছে। নিজের সন্তানের মাঝেও সে তৃষ্ণা খুঁজে পেত, ভেসে উঠত আরতির মুখ। প্রতিশোধ নিল সেই কাঠের পুতুলটি।
সব মিলিয়ে গল্পটি আমার বেশ লেগেছে। অন্তত আমাদের যেই দেশে ধর্ষকের বিচার হয় না,সেটা গল্পে হলেও একটি কাঠের পুতুল করে দেখিয়েছে।
শুভ কামনা।