গল্প লেখক: আকরাম হোসাইন তাহসিন
…………………………..
জীবন মামার থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে স্টেশনে চলে আসলাম। অনেক চেষ্টা করেও কোনো টিকেট পাইনি। সিটইীন টিকেট কাটার চেয়ে বিনা টিকেটে সিটে বসে যাওয়া আরামদায়ক। এমন সুযোগ আমি অনেকবার পেয়েছি। একদিন মোহনগন্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের ফাস্টক্লাসে বসে আছি। ট্রেন যখন জয়দেবপুর জংশন অতিক্রম করেছে তখন কয়েকজন টি-টি এসে টিকেট চেক করতে লাগলো। আমার কাছে এসে একজন বললো, ‘কোথায় যাবেন?’ আমি বললাম, গফরগাঁও।
নিচের দিকে তাকিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে টিকেট বের করে দেখি টি-টি নেই। পাশের সিটে বসা এক মধ্যবয়সী লোক মুচকি হেসে বললো, গফরগাঁও যাবেন তো; তাই ভয় পেয়েছে! এরপর থেকে যত টি-টিদের সাথে কথা হয়েছে সবাই গফরগাঁওয়ের নাম শুনে ব্রিবত হয়। যেন টিকিট চেয়ে তারা বিরাট অন্যায় করে ফেলেছে; এমন ভাব। ব্যাপারটা আমার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগে। ভেরি ইন্টারেস্টিং।
স্টেশনে বসে ১০মিনিট ওয়েট করার পর তিস্তা এক্সপ্রেস ট্রেন আসলো। এই ট্রেনটা বেশীক্ষণ প্লাটফর্মে দাঁড়াবে না। একটু পরেই দৌঁড়াতে আরম্ভ করবে। এক দৌঁড়ে গফরগাঁও তারপর জয়দেবপুর টু ঢাকা। আমি দেরী না করে এসি বগিতে উঠে পড়লাম। আজকে আমার পকেটে টিকিট নেই। টিকিটবিহীন যাত্রী আমি।
ট্রেনে উঠার সময় সবার মধ্যেই একধরনের অস্থিরতা কাজ করে। আমি তার ব্যাতিক্রম নই। তাড়াহুড়ো করে উঠে বসে দেখি আমার পাশের সিটে এক সুন্দরী তরুণী। সে মাঝমধ্যে আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। আড়চোখে তাকালে যেকোনো মেয়েকেই সুন্দর লাগে। রূপবতীদের লাগে ভয়ংকর রকমের সুন্দর।
ট্রেনের লাইন ক্লিয়ার হওয়ার পর ট্রেন হুইসেল দেয় অন্য গাড়ি হুইসেল দিয়ে লাইন ক্লিয়ার করে। ব্যাপারটা মজার। ট্রেন ছাড়ার পর আমার পাশের সিটে বসে থাকা সুন্দরী মেয়েটি বলে উঠলো, “এই সিটটা আমার!” আমি কিছুটা হতভম্ব হয়ে বললাম, “আমি কি উঠে যাব?” মেয়েটি বললো, “নাহ্। গফরগাঁও পর্যন্ত যেতে পারবেন। গফরগাঁও স্টেশন থেকে আমার একজন লোক উঠবে।”
আমি বললাম, “ঠিক আছে।”
ট্রেন যখন ধলা অতিক্রম করলো। তখন মেয়েটি বারবার কাকে যেন কল দিচ্ছে। কল রিসিভ হচ্ছে না। মেয়েটিকে হতাশ লাগছে। এই প্রথম কারো হতাশা দেখে আমার ভালো লাগছে। ভালো লাগার কারণ আমি সিটে বসে আরাম করে ঢাকা পর্যন্ত যেতে পারবো। এই জগতের সবাই আত্মকেন্দ্রিক। আমি হলে খারাপ কি!
গফরগাঁও স্টেশনে ৫মিনিট দাঁড়ানোর পর ট্রেন আবারও দৌঁড়াচ্ছে। মেয়েটি মন খারাপ করে বসে আছে। মেয়েরা তুচ্ছ কারণে মন খারাপ করে। কিন্তু এই মেয়েটির মন খারাপের কারণ তুচ্ছ মনেহচ্ছে না। আমি কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে আপু?” মেয়েটি কিছু বললো না। সে জানালা দিয়ে বাহিরের অন্ধকার দেখছে। আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরে হেলান দিয়ে বসে আছি। কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে থাকার পর সত্যি সত্যিই ঘুম চলে আসছে। ভয়াবহ রকমের ঘুম। খুব ইচ্ছে হচ্ছে কোনো একটা কেবিনে গিয়ে গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ি। এবং লম্বা একটা ঘুম দিই। দীর্ঘ ঘুমের পর জেগে উঠে দেখবো তিস্তা এক্সপ্রেস ট্রেন ঢাকা ঘুরে পুনরায় ময়মনসিংহে ফিরে এসেছে। তাতে খারাপ হয় না।
ঘুমের ঘোরে শুনতে পাচ্ছি কেউ একজন আমাকে মিষ্টি কন্ঠে ডাকছে। ‘এই যে উঠুন। ট্রেন স্টেশনে চলে এসেছে।’ ব্যাপারটা আমার কাছে স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে অস্পষ্ট অপ্সরীর ডাক স্বপ্নের প্রথম স্ট্রেজ। এরপর সেই অপ্সরী আমার কাছে আসবে, আমার মাথায় হাত ভুলিয়ে দিবে আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে যাব। স্বপ্নের পরবর্তী স্টেজের অপেক্ষা না করে চোখ মেলে দেখি আমার পাশের সিটে বসে থাকা সুন্দরী মেয়েটি মধুর স্বরে ডাকছে। আশেপাশে কেউ নেই সবাই নেমে গেছে। ট্রেনে শুধু আমি আর এই মেয়েটি। সে বোধহয় একটু ভয় পাচ্ছে। আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন কন্ঠে বললাম, ‘সরি’। মেয়েটি বললো, ‘এবার নামুন’।
আমি ট্রেন থেকে নেমে হা তুলে চারপাশ দেখছি। ঘন্টাদুয়েক এসি বগিতে বসে বেশ ভালোই ঘুম হয়েছে। ফ্রেশ লাগছে। এখন এক কাপ চা খেতে পারলে আরো ফ্রেশ লাগতো। চা খাওয়ার উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলাম। এমন সময় ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখি সেবা ফোন করেছে। কল রিসিভ করে বললাম, – কেমন আছো সেবা?
– আমি সবসময়ই ভালো থাকি।
এই মেয়েটির এই এক কথা। যখনই জিজ্ঞেস করবো কেমন আছো? তার সেইম উত্তর “সবসময় ভালো।”
আমি বললাম, – মাঝেমধ্যে খারাপ থাকা দরকার। খারাপ থাকলে ভালো থাকার মর্মটা বুঝা যায়।
– থাক আপনাকে আর জ্ঞান দিতে হবে না। আপনি ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর না। আপনি তাহসিন। আপনার কাজ মানুষকে রক্ত সংগ্রহ করে দেওয়া। জ্ঞান দেওয়া না।
– তুমি কি কোনো কারণে রেগে আছো সেবা?
– আপনার উপর রাগ করা অর্থহীন! যাক যে জন্য ফোন দিয়েছি….! আপনি এখন কোথায় আছেন?
– কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে হাঁটতেছি।
– ওখানে কেন?
– তোমার জন্য লাল চুড়ি আর লিপস্টিক কিনতে এসেছি। লাল চুড়ি পরলে তোমাকে সুন্দর লাগবে। আচ্ছা একটা কাজলও কি আনবো?
– রসিকতা করবেন না। রসিকতা আমার পছন্দ না। আগামীকাল সকালে আমার সাথে দেখা করবেন। সকাল ঠিক ৯টায় ময়মনসিংহ সার্কিট হাউস মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন।
– সাইডে দাঁড়ালে হবে না? মাঝখানে দাঁড়ালে তো তুমি আমাকে দেখতে পাবে না। সকালে খুব ঘন কুয়াসা পড়ে।
সেবা হুট করে ফোন রেখে দিয়েছে। বুঝতে পারলাম সে আমার সাথে রাগ করেছে। ভয়াবহ রকমের রাগ। কেউ আমার সাথে রাগ করেছে ভাবতেই ভালো লাগে। নিজেকে তখন খুব বড় বড় মনেহয়। রাগ করার একটা অধিকার থাকে সেই অধিকারটা খুব প্রিয় মানুষরাই দেখাতে পারে। যে আপনাকে বড্ড বেশী আপন মনে করে।
সেবার সাথে কথা বলতে বলতে স্টেশন থেকে বের হয়েছি। বের হয়ে পাশ ফিরতেই দেখি পাশের সিটে বসা সুন্দরী মেয়েটি আমার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে। কি অদ্ভুত চাহনী। এসব চাহনীকে উপেক্ষা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। আমি দ্রুত হেঁটে রাস্তা পার হয়ে চলে যাচ্ছি। মেয়েটি আমার সাথে সাথেই হাঁটছে। আমি হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম। মেয়েটি আমার কাছে এসে বললো “আপনি কোথায় যাবেন?”
– তা জেনে আপনি কি করবেন?
– আপনার সাথে যাব।
– মানে?
– মানে আমি আপনাকে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা নিয়ে এসেছি। এখন আপনি আমাকে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ নিয়ে যাবেন।
– ঢাকা কেন এসেছেন?!
মেয়েটি কোনো কথা বলছে না। কিন্তু সে এটা পরিস্কার বুঝিয়ে দিয়েছে, তাকে এখন ময়মনসিংহ নিয়ে যেতে হবে। যতক্ষন না আমি ময়মনসিংহ যাচ্ছি ততক্ষন সে আমার সাথেই থাকবে। কি উদ্ভট এক ঝামেলা।
নাহ্ সুন্দরী মেয়েদের ঝামেলা ভাবা উচিত না। তাতে সুন্দরের অপমান।
মেয়েটিকে সাথে নিয়েই যাত্রাবাড়ি গেলাম। সেখানে এক ভাইয়ের সাথে কিছু কাজ ছিলো। তাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে ভাবলাম জামান ভাইয়ের বাসায় যাব। জামান ভাই আমার এলাকার বড় ভাই। উনিও থাকেন যাত্রাবাড়ি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই মেয়েকে নিয়ে বড় ভাইয়ের বাসায় যাওয়া যাবে না। কেলেঙ্কারি টাইপ কিছু একটা হয়ে যাবে। ভাবছিলাম পুরান ঢাকায় যাব। আমার বোন লাভলীকে একটু দেখা দরকার। ইদানিং মেয়েটা খুব অসুস্থ। কিন্তু সেটাও হলো না। এই মেয়েটিকে নিয়ে কিছুই করা যাচ্ছে না।
সোডিয়াম লাইটের আলোতে দুজন পাশাপাশি হাঁটছি। আমি ভাবছি সেবাকে নিয়ে। এই মেয়েটা যদি এখন আমার পাশে থাকতো তাহলে উদ্ভট উদ্ভট যত্তসব কথা বলতাম সে ভীষণ রাগ করতো। এই রাগটাই আমার ভালো লাগে। এই মেয়েটিও নিশ্চয়ই কাউকে না কাউকে নিয়ে ভাবছে।
এখনো মেয়েটির নাম জানা হয়নি। নাম জেনে কি হবে? তবুও জিজ্ঞেস করলাম। সে হুট করে বলে দিলো, ‘আমার নাম মিতু’!
আমি বললাম, “মিতু মন খারাপ করে থাকবেন না। আপনি যাকে ভালোবেসে পালাতে চেয়েছিলেন! সে আগেই পালিয়ে গেছে। বিয়ের পর পালালে ব্যাপারটা কতো ভয়ংকর হতো ভেবে দেখছেন?”
মেয়েটা আমার কথা শুনে পুরোপুরি হকচকিয়ে গেছে। তার এই হতচকিত ভাব কাটাতে প্রায় এক মিনিট সময় লাগলো। এখনো তার বিস্ময় পুরোপুরি কাটেনি। সে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বললো, “আপনি কিভাবে জানলেন?!”
– অনুমান করেছি মিতু।
মেয়েটা কিছু বললো না। কিছুক্ষন পর খেয়াল করে দেখলাম তার মন খারাপের ভাবটা পুরোপুরি কেটে গেছে। এখন মেয়েটিকে আনন্দিত মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে ছেলেটি তাকে ছেড়ে যাওয়াতে সে অনেক খুশী।
মিতু আমার পাশের সিটে বসে আছে। ট্রেনের ল্যাম্পের আলোতে মেয়েটাকে অসম্ভব মায়াবী লাগছে। আমি চিন্তা করছি অন্যকথা, আচ্ছা মায়াবতীর কোনো পুরুষ বাচক শব্দ হয় না? হলে সেটা কি হবে? বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান সাহেবের সাথে একদিন কথা বলতে হবে।
মিতু ঘুমের ঘোরে ঝিমুচ্ছে। সে যেকোনো সময় আমার কাঁধে মাথা রাখবে। আমি বললাম, মিতু….
– হু।
– চা খাবে? চা খেলে ঘুমের ভাবটা কেটে যাবে।
– আচ্ছা দাও।
এই মেয়েটা এতক্ষন আমাকে আপনি করে বলছিলো। এখন তুমি! আরেকবার চট করে বলে ফেলবে তাহসিন আমি তোমাকে ভালোবাসি। তখন ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং হবে। আমি তাকে কয়েকটা উপদেশ বানী ধরিয়ে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাব। সেই হাঁটার মধ্যে ছন্দ থাকবে।
চা ওয়ালাকে ডাক দিলাম। সে নিতান্ত অসহায় ভঙ্গিতে আমার হাতে চা ধরিয়ে দিলো। মিতু চা খাচ্ছে। ঠোঁটদুটো বাঁকিয়ে চায়ের কাপে ফুঁ দিচ্ছে। কাপ থেকে ধোঁয়া উড়ে তার পুরো মুখে লেপ্টে যাচ্ছে; দৃশ্যটা দেখতে অসাধারণ লাগছে। পৃথিবীর সুন্দর দৃশ্যগুলোর একটা লিস্ট করলে সেখানে নির্দ্বিধায় সুন্দরী কোনো তরুণীর চা খাওয়ার দৃশ্য লিপিবদ্ধ করে ফেলা যাবে।
দীর্ঘ ৩ঘন্টা পর ময়মনসিংহ স্টেশনে পৌঁছালাম। স্টেশনে ট্রেন থামতেই মিতুর অগোচরে নেমে হাঁটা ধরছি। হাঁটতে হাঁটতে টাউনহল যাব। জীবন মামার বাসায় গিয়ে একটা লম্বা ঘুম দিব। আচ্ছা মিতু মেয়েটা কি আমাকে খুঁজবে? হয়তোবা খুঁজবে। কোনো একদিন দেখা হলে বলবো “মিতু তোমার ওষ্ঠদ্বয় বাঁকিয়ে চায়ের কাপে ফুঁ দেওয়ার দৃশ্যটা ভীষণ মিস করি। তুমি কি রেলক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে আমার সাথে আরেক কাপ চা খাবে?”
Onnekk sundor golpo…..
Very nice story…….
🙂
লেখার টাইপ খুব সুন্দর