লেখকঃ সুমাইয়া সারাহ মিষ্টি
………………
আজ টুনার জন্মদিন ছিলো। জন্মদিনে সাধারণত মানুষ খুব খুশি থাকে। অথচ মেয়েটা কাঁদছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে…
কান্নার শব্দ যেন বাড়ির কারো কানে না যায় সেজন্য সে সবার আড়াল হয়ে ছাদে উঠে কাঁদছে…
তার কান্নার কারণ অমিত ভাই।
গত একমাস থেকে টুনা রোজ একবার করে অমিত ভাই কে কল দিয়ে বলেছে যেন আজকের দিন টা টুনাকে দেয়।
প্রতিবারই অমিত ভাই খুব বিশ্রী রকমের হাসি দিয়ে বলেছে “টুনা হলো মাছের নাম! আর আমি মাছ খাই না। তাই টুনা থেকে দূরে থাকতে চাই। সময় হবেনা!”
টুনা সাথে সাথে বলেছে “অমিত, আমার নাম টুনা না! আমার নাম টয়না! আমার বড় আপার নাম ময়না, তার নামের সাথে মিলিয়ে আমার নাম টয়না! প্লিজ অমিত ভাই, একটা দিনই তো চেয়েছি! না করবেন না প্লিজ!”
রোজ একই কথা বলার জন্য কল দিয়েছে টুনা। আর রোজই এরকম বিভিন্ন বাহানা দিয়ে অমিত ভাই বলেছে সময় হবেনা…
টুনার মনে হতো অমিত ভাই এসব এমনিই বলছে। জন্মদিনে তাকে সময় দিবেই।
সে মনে করে জন্মদিন উপলক্ষ্যে কারো কাছে কিছু চাইলে কেউ না করে না।
এই যেমন সেদিন লজ্জার মাথা খেয়ে বাবাকে বললো “বাবা ময়না আপা আমার জন্মদিন উপলক্ষ্যে শাড়ি পাঠাবে। শাড়ির সাথে চুড়ি কিনতাম, টাকা নেই। তুমি কি কিছু টাকা দিবা?”
বাবা হাসিমুখে বললেন “আচ্ছা আমার সাথে যেয়েই নিস!”
অথচ অন্য সময় চুড়ি চাইলেই বাবা বলতেন “হাত ভর্তি চুড়ি পরে বেদেনী রা! চুড়ি পরতে হবেনা! এসব আবদার নিয়ে আসবি না আমার কাছে!”
জন্মদিন বলে চুড়ি কিনে দিবে বাবা। ময়না আপাও শাড়ি কিনে দিয়েছে জন্মদিন উপলক্ষেই…
যদিও শাড়িটা টুনা নিজেই চেয়েছে…
আপা কল দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো “কি রঙের সালোয়ার কামিজ নিবি? তোর দুলাভাই কে বলবো দোকান থেকে আনতে, দোকানে নতুন কাপড় এসেছে। ইশ কি যে সুন্দর সবগুলা! মন চাচ্ছে সব নিয়ে নিই! কিন্তু নিলে ব্যবসা চলবে কিভাবে? যাই হোক বল, কি রঙের নিবি?”
টুনা খানিকক্ষণ এই ওই কথা বলে বললো “আপা, আমার না একটাও শাড়ি নাই। বান্ধবী রা মাঝেমাঝে শাড়ি পরে, আমার খুব শখ হয়…যদি দুলাভাই কে বলে একটা হলুদ শাড়ি দিতে……
শাড়ি চাওয়াতে আপা যতটা না অবাক হয়েছে তারচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে রঙ শুনে।
হলুদ রঙ টুনা সহ্যই করতে পারেনা।
ময়নার গায়ে হলুদের দিন হলুদ শাড়ি পরে এসে যখন জিজ্ঞেস করলো “টুনা আমাকে কেমন লাগছে রে?”
বিরক্তিকর চেহারা করে টুনা বললো “ভীষণ রকমের ক্যাটকেটে লাগছে! এতো সুন্দর দিনে এরকম রঙ না পরলে হয় না আপা!?”
সেই টুনাই কি না হলুদ শাড়ি চাচ্ছে?
চাচ্ছে কারণ এই ক্যাটকেটে হলুদ রঙ অমিতের খুব পছন্দের।
টুনার ইচ্ছে ছিল হলুদ শাড়ি, চুড়ি, কাজল, টিপ পরে আলতো একটা খোঁপা বেধে যাবে অমিত ভাইয়ের সামনে।
তারপর বলবে “জানেন তো হলুদ আমার বাজে লাগে! তবুও পরেছি! শুধু আপনার জন্য! আমাকে কেমন লাগছে অমিত ভাই?”
সে জানে, খুব সুন্দর লাগলেও অমিত ভাই বলবে “ছিঃ, এরকম বাজে তোমাকে আগে কখনো লাগেনাই! কোন দুঃখে এই রঙ পরলা?”
বাজে লাগছে শোনার জন্য হলেও আজ অমিত ভাইকে প্রয়োজন ছিল! জন্মদিন টা সুন্দর করার জন্য হলেও অমিত ভাইকে প্রয়োজন ছিল।
কিন্তু টুনার প্রয়োজনের সাথে অমিতের প্রয়োজন মিলছিলো না, তাই অমিত আগেরদিন থেকেই নিরুদ্দেশ হয়েছে…..
আজ সকালবেলা উঠে আপার পাঠানো হলুদ শাড়ি, বাবার সাথে যেয়ে কেনা চুড়ি পরে সেজে সে বের হয়েছিলো পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানের উদ্দেশ্যে…
টুনা জানে ঘুম থেকে উঠে, অফিসে যাওয়ার জন্য বের হয়ে অমিত এখানে চা খেতে আসে। সকালবেলা এক কাপ চা, আর দুটো বিস্কিট খেয়েই সকালের নাস্তা সাড়ে অমিত।
টুনার ইচ্ছে ছিল আজ বলবে “অমিত ভাই চলেন আজ আপনাকে পরোটা মিষ্টি আর মুরগীর মাংস দিয়ে নাস্তা করাই। আমার জন্মদিন উপলক্ষে আমিই খাওয়াবো। আপনি খাবেন, আমি দেখবো!”
খাওয়া শেষ করে সারাদিন ঘুরে বেড়ানোর প্ল্যান ছিল।
কিছুই হলো না।
সকালবেলা চায়ের দোকানে অমিত ভাই এলো না। টুনাকে হলুদ শাড়িতে বাজে লাগছে বললো না। সারাদিন ঘুরা হলো না। টুনার দিন টা ভালো গেলো না।
সকাল থেকে দুপুর অবধি চায়ের দোকানের পিছনের কদম গাছের নিচে বসে কাটিয়েছে সে…
তারপর বাসায় ফিরে এসেছে। ফিরে আসার সময় চায়ের দোকানের বাবলুকে বলে এসেছে অমিত ভাই আসলেই যেন টুনাকে খবর দেয়। বকশিস হিসেবে ১০ টাকার ২টো নোট গুঁজে দিয়েছে বাবলুর হাতে….
ফিরে এসে নতুন শাড়ি পরেই ঘরের কাজ করেছে। রান্না করেছে, ঘর ঝাড়ু দিয়েছে, কাপড় কেচেছে…
টুনার মা নাই, তাই এসব কাজ তাকেই করতে হয়।
সারাদিন কাজের মাঝে থাকলেও মন টা ছিল চায়ের দোকানে…
ওপরে শান্ত থাকলেও মনের ভেতরে ঝড় বইছিলো। মোচড় দিয়ে ব্যথা হচ্ছিলো। গলার কাছ টায় কি যেন আটকে আসছিলো….
এভাবেই সারাদিন কাটিয়ে এখন রাত্র ১০ টা বাজে…
গেটের কাছে গাড়ির হর্ণ শোনা যাচ্ছে…
এতো রাতে আবার কে এলো? আপা দুলাভাই না কি?
ছাদের কোণে যেয়ে উঁকি দিতেই দেখা যায় গাড়ি থেকে বের হয়েছে অমিত ভাই। আরেক দরজা খুলে বের করছেন তার মা কে…..
মানে কি? অমিত ভাই এখানে? সাথে তার মা?
টুনার পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে! সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না খুশিতে…..
দৌড়ে নিচে নামতে যাচ্ছিলো টুনা…
হয়তো ভুলে গেছিলো আজ সে শাড়ি পরেছে, আর শাড়ি পরে বড় ধাপে হাটা যায় না, দৌড়ানো দূরের কথা….
সিঁড়িটাও আজ অপরিচিত হয়ে গেলো!
শাড়িতে পা বেধে সিঁড়ি থেকে পরে গেলো টুনা। মুহূর্তের মধ্যেই তার হলুদ শাড়ি লাল হয়ে গেলো রক্তে….
টুনার পরে যাওয়ার শব্দে ছুটে এলো বাড়ির সবাই…তাদের সাথে অমিত। টুনার ভালবাসার অমিত…
টুনা কিছু বুঝতে পারছে না! কি হচ্ছে তার সাথে? সে দৌড়ে নামতে চায়, অমিতের কাছে যেতে চায়! অমিতের বুকে কিল বসিয়ে অভিমান নিয়ে বলতে চায় “সারাটা দিন অপেক্ষা করেছি! কই ছিলেন আপনি?”
সে কেন উঠতে পারছেনা? কেন তার হলুদ শাড়ি লাল হয়ে যাচ্ছে!?
সে লাল শাড়ি চায় না! সে চায় অমিতের প্রিয় রঙের হলুদ শাড়ি!
সে শক্তি পাচ্ছে না। নেতিয়ে পরে আছে…
আধাখোলা চোখে দেখতে পাচ্ছে সবাই কান্নাকাটি করছে, এ্যাম্বুলেন্স ডাকছে, তাকে ডাকছে….
সবার ডাকের মাঝে রয়েছে তার প্রিয় অমিতের ডাক….
“টুনা, এই টুনা! চোখ টা বন্ধ করোনা প্লিজ! সত্যি বলছি আর কখনো তোমাকে কষ্ট দিবো না, টুনা মাছ বলবো না! রোজ দেখা করব! এই দেখো টুনা আমি মা কে এনেছি, তোমাকে আজ নিজের ঘরে নিয়ে যাব তাই এনেছি! আমি মা কে আনতে গেছিলাম টুনা, প্লিজ তুমি ভুল বুঝে যেওনা! আমি তোমাকে ভালবাসি টুনা! শুধুমাত্র আজকের দিনে বলবো বলে এতো মাস বলিনি…প্লিজ টুনা কিছু বলো!”
টুনা সব শুনতে পাচ্ছে। তার ইচ্ছে করছে চিৎকার দিয়ে বলতে “অমিত আমি জানি, তুমি আমাকে ভালবাসো, ভীষণ ভালবাসো! আমি তোমাকে ভুল বুঝিনি, একটুও ভুল বুঝিনি! আমার বিশ্বাস ছিল তুমি আসবে…আসবেই!”
ইচ্ছে করলেও কিছুই বলতে পারছে না। টুনার গলা থেকে শব্দ বের হচ্ছে, কিন্তু কথা না….তার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে, চোখ বন্ধ হয়ে আসছে…
অমিতের কান্না বাড়ছে। সাথে বাড়ছে ভালবাসার কথা! এতদিন যেসব কথা শোনার অপেক্ষায় ছিল সেসব কথা আজ বলে দিচ্ছে অমিত….
এ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শোনা যাচ্ছে। টুনার ইচ্ছে করছে এ্যাম্বুলেন্স টা ভেঙে ফেলতে! যেন সে শব্দে অমিতের কথা চাপা না পরে….
টুনার চায় অমিতের কথা শুনতে, সারাজীবন শুনতে, জীবনের শেষ সময়টুকুই শুনতে……
কিন্তু এখন টুনার মনমতো কিছুই হচ্ছে না! সবকিছু পেয়েও যেন কিছুই পাচ্ছে না!
এই অমিত টা এলো ঠিকই, এলো অবেলায়!
০ Comments