জীবন্ত স্মৃতি
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১০, ২০১৮
লেখকঃ

 2,780 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ

জীবন্ত স্মৃতি।
-মারুফা ইয়াসমিন।

উত্তরের হিমালয় থেকে আগত শিশির সিক্ত হিমেল হাওয়া যখন বইতে থাকে বাংলার বুক জুড়ে, তেজি সূর্যিমামা টাকেও রেহাই দেয় না তার হিমশীতল পরশ,সূর্যের তুখোড় দীপ্তশীখা যেন মিষ্টি আবেশের সৃষ্টি করে।
প্রকৃতি তার রূপের ঝলকানি তখন শুষ্কতার চাদরে ঢেকে রাখে।গাছে গাছে পত্র-পল্লব শিশিরে ভিজে মিষ্টি রোদের আভায় চিকচিক করতে থাকে। শীতের আমেজ মাখামাখিতে ব্যস্ত রঙিন প্রকৃতি আমাদের মনের কোণেও রং ছিটিয়ে দিতে ভুল করে না।ঠিক তখনই দেশ ভ্রমণের নেশা হৃদয়ে কড়া নাড়ে।
রূপ-লাবন্যে ভরপুর বাংলার প্রকৃতি।
সেই লাবন্যময়ী রূপের ছটা গায়ে মেখে নিতে ব্যস্ত হয় হাজারো মানুষ।
ভীড় জমায় পর্যটন কেন্দ্র গুলোতে।
আমি ও তার ব্যতিক্রম নয়।বরাবর ভ্রমণ প্রিয় একটি মানুষ। ভ্রমণ যেন আমার পিপাসার্ত হৃদয়ের তৃষ্ণা নিবারণ করে।যদি হয় শীতকাল,তাহলে তো কথাই নেই।
হাজারো স্মৃতি জড়িয়ে থাকে একেকটি ভ্রমণের সাথে।
তেমনি এক শীতের ভ্রমণ জীবন্ত স্মৃতি হয়ে আছে মোর ছন্নছাড়া ক্ষুদ্র পরিসরের এই জীবনে।
আমি ইভানা ইসরাত ইম্মি।
বিভাগীয় শহরের একটি প্রাইভেট ভার্সিটির ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট এর লেকচারাল। মাস ছয়েক আগে চাকুরীতে জয়েন করেছি।আমি এই ভার্সিটির ছাত্রী ছিলাম। বরাবর রেজাল্ট ভাল ছিল,তাই এম.বি.এ শেষ করতে না করতেই আমার ডাক পড়ে যায় শিক্ষিকা পেশায়।
বিবাহিত জীবনের দু’বছর কেটে গেল বেকারত্ব নিয়েই। অনেক স্ট্রাগল করতে হয়েছে দু’জনকেই।
বর বলি আর বেস্টফ্রেন্ড বলি, আমার ছোট বড় স্বপ্ন গুলো বাস্তবে রূপ দিতে এক অন্যান্য চরিত্র নেহাল ইফতি নীল।
আমরা এক ভার্সিটিতেই বি.বি.এ তে ভর্তি হয়েছিলাম। নীল আর আমি একসাথেই এম.বি.এ টা শেষ করলাম।
নীল ভার্সিটি সেরা স্টুডেন্ট ছিল।
মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে হওয়ায় বিদেশ গিয়ে ম্যানেজমেন্ট পড়ার স্বপ্নটা পূর্ণ হলো না তার।
ঘটনাক্রমে আমরা একে অন্যের সাথে জড়িয়ে পড়ি।
সাত মাস আগে একটি বেসরকারি ব্যাংক নীল কে ডেকে নেয়। অনেক চিন্তা ভাবনা করে চাকুরী তে যোগদান করতে বলি তাকে। তখন আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না।
এখন আমরা মোটামুটি না,বলা চলে বেশ ভাল আছি।
আমি নীল আর আমাদের ২ বছরের ছেলে নাবিল হাসান ইভান।
দেখতে দেখতে ইভানের ২য় জন্মদিন চলে আসল। এই তো সেদিনের কথা, যেদিন প্রথম ও কে আমার বুকে আগলে নিলাম, আমার অশ্রুসিক্ত চোখ থেকে এক ফোটা জল ইভান এর গায়ে পড়েছিল, তড়িঘড়ি করে মুছে দিয়েছিলাম। মায়া ভরা মুখের আদল টা যেন আমার বুকে বিধে গিয়েছিল। কিসের এত টান?
আমি আজও খুঁজে পাইনি সেই প্রশ্নের উত্তর।
ভুলে যেতে চাই সব কিছু।নতুন করে বাঁচতে চাই, কিন্তু স্মৃতির পাতায় হঠাৎই কে যেন বিচরন করে বেড়ায়। শীতকালের একটি ভ্রমণ আমাদের জীবনের গতি এভাবে ঘুরিয়ে দিবে, এটা কল্পনাতীত ছিল।

প্রায় প্রতি বছর আমাদের ভার্সিটি থেকে বনভোজনের আয়োজন করত।সে বছর আমরা সিলেট গিয়েছিলাম।
আমি, ইভা, রোদেলা,নীল আর ফাহাদ,আমরা ৫ জন সব সময় একসাথে থাকতাম।যেন এক সুতোয় গাঁথা ৫ টি প্রাণ।ভার্সিটিতে সবাই আমাদের ফাইভ স্টার বলে ডাকত।
মাস দুই যাবৎ রোদ আর নীলের মাঝে কিছু একটা চলছিল।আমরা সবাই বুঝতে পেরেছিলাম। তাই ওদেরকে কিছু সময় আলাদা করে রাখতাম।বেশ মজা করতাম ওদের নিয়ে।
২দিনের সফর ছিল।
নতুন কিছু অভিজ্ঞতা আর সীমাহীন আনন্দধারার বন্যা বইতে থাকে সবার মাঝে।
আনন্দদায়ক মূহুর্ত্তের মাঝে হৃদয় বিদারক কিছু ঘটনা গুলো মনে দাগ কেটে দেয়।
সফর শেষে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে আমরা রওনা হই।হঠাৎই মাঝপথে বাস থেমে যায়।
আমরা সবাই কারণ জিজ্ঞাসা করলে ড্রাইভার জানিয়ে দেয় সামনে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। আমি বরাবর উৎসুক প্রকৃতির মেয়ে। মনের অদম্য ইচ্ছেশক্তিকে দমন করতে না পেরে ঘটনাস্থলে চলে যাই। আমার পিছু পিছু ওরাও চলে আসে।
চোখের পলকে মাঝ রাস্তায় মাঝ বয়সী একটি মেয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।নিথর দেহ খানি পরে রইল রাজপথ রাঙিয়ে দিয়ে।পুরো শরীর তাজা রক্তের দাগ, একটি হাত দেহ থেকে আলাদা হয়ে ছিটকে ৫ হাত দূরে পরে আছে। শরীরের একপাশ পুরো পিষে দিয়ে গেছে মোটরসাইকেলের চাকা।
সবাই বলাবলি করছিল মেয়েটা নাকি পাগলী ছিল,সদ্য একটি পুত্র শিশুকে ভুমিষ্ঠ করেছে,রাস্তার ধারে বসে সারাদিন ভিক্ষে করত আর রাতে ফুটপাতেই পরিশ্রান্ত দেহ খানি এলিয়ে দিয়ে ক্লান্তি মেটাতো।
দৃশ্যটা দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছিলাম না। হার্টবিট যেন পাগলা ঘোড়ার মত ছুটাছুটি করতে থাকে।
গায়ে চাদর জড়ানো ছিল তবুও ঠকঠক করে কাঁপছিলাম।
হঠাৎই কানে ভেসে আসল নবজাতকের কান্নার আওয়াজ।
পাশ ফিরে তাকাতেই চোখে পড়ল একটি সদ্য পরিস্ফুটিত টুকটুকে লাল সাদা গোলাপের মত শিশু হাত পা ছুড়ে কান্না করছে।
আমি দৌড়ে গিয়ে কোলে তুলে নিলাম। কেউ হয় তো খেয়াল করেনি বাচ্চাটার দিকে।ততক্ষণে সবার নজর পড়ে গেল আমার দিকে।
ফাহাদ,নীল আর ইভা আমার দিকে এগিয়ে আসল। শীতের প্রকোপে পুরো ঠান্ডা হয়ে গেছে বাচ্চা টা,আমি মুখের দিকে তাকিয়ে কি যে এক মায়ার জালে আটকে গেলাম, একেবারে বুকের সাথে চেপে ধরে আছি। তাকিয়ে দেখছি ওর কোমল মুখখানি। এতটুকু একটা শিশু তার মা কে হারালো। কখনো জানতেই পারবে না ওর মা দেখতে কেমন ছিল?
কোথায় থাকত?
ভাবতে ভাবতে
মনের অজান্তেই চোখের কোন বেয়ে দুফোঁটা অশ্রুজল টুপ করে গোলাপের গালে পড়ে গেল। মা হওয়ার সুখের অনুভুতি যেন আমাকে ঘিরে ধরে।
সেদিনের সেই সদ্য পরিস্ফুটিত গোলাপ টিকে শুকনো পাতার মতো ঝরে পড়তে দেইনি। কিছু মানুষের ভুল বোঝাবুঝি তে নিজের সম্মানহানি করেও তাকে বাঁচিয়ে রেখেছি।পিছু লোকে তো কত কথাই বলে।সেদিন একমাত্র নীল কে বলতে বাধ্য হয়েছিলাম,আমি কখনো মা হতে পারব না।প্রথম কোনো ছেলেকে স্বচক্ষে কাঁদতে দেখেছিলাম।হয় তো আমার কষ্ট টা ভাগাভাগি করে অনুভব করার জন্য নীল আর পিছু ফিরে তাকায়নি।
আমার এই মহৎ কাজে শামিল হওয়ার লোভনীয় সুযোগটা নীল হাতছাড়া করতে পারে নি। নীল তার বন্ধুত্বের দাম দিতে গিয়ে রোদ এর কাছে চরিত্রহীন বলে গণ্য হয়েছে।
নীলের কোনো আফসোস নেই তাতে।
এখন আমাদের হাজারটা স্বপ্ন ইভানকে ঘিরে।
কে বলেছে আমি মা হতে পারব না?
ইভানের মুখে কথা ফুটেছে।আধো আধো বুলিতে মা মা বলে ডেকে আমাদের ছোট্ট ঘর টাকে কম্পিত করে তোলে। নীল শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে মা-ছেলের কান্ড দেখে আর খুশিতে চোখের কোন ভেজায়।আমার কোল জুড়ে এখন একটি জ্যোস্নাশোভিত পূর্নিমা চাঁদ।
রোজ নতুনভাবে আলোর ছটা বিলাতে থাকে এই ছোট কুঁড়েঘরটা তে।

সম্পর্কিত পোস্ট

পূনর্জন্ম

জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...

অনুভূতি

অনুভূতি

লেখা: মুন্নি রহমান চারদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লো মালা। ঘরের কাজ সেরে বের হতে হবে ফুল কিনতে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না আর ফুল তরতাজা না হলে কেউ কিনতে চায় না। মাথার ওপরে তপ্ত রোদ যেন...

অসাধারণ বাবা

অসাধারণ বাবা

লেখক:সাজেদ আল শাফি বাসায় আসলাম প্রায় চার মাস পর। বাবা অসুস্থ খুব।তা নাহলে হয়তো আরও পরে আসতে হতো।গাড়ি ভাড়া লাগে ছয়শো পঁচিশ টাকা।এই টাকাটা রুমমেটের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।তার কাছে এই পর্যন্ত দশ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে।বলি চাকরি হলেই দিয়ে দিব। পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর...

০ Comments

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *