writer : হি মু (বাকুম)
কাল চারটি চেয়ারে চারজন বসে আছে। নিশ্চিত তাদের হৃৎপিন্ড গলার কাছে বিট দিচ্ছে। কারন, কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেদের ভিডিও ক্লিপ দেখিয়ে জেরা করা হবে তাদের। এ চারজনের মধ্যে থেকে বের করে আনা হবে আসল খুনিকে।
এসব হয়ত হত না, যদি না কলকাতার বিখ্যাত গল্প লেখক সুরেশ চক্রবর্তী বাংলাদেশে রহস্যময় ভাবে খুন না হতেন। ভদ্রলোক খুন হয়েছেন ফাইভ স্টার হোটেলে নিজের রুমে।
সুরেশ চক্রবর্তীর রুমে কোন গোপন ভিডিও ক্যামেরা ছিল না। কিন্তু রুমের বাইরে করিডরে ছিল। কে কে সেদিন কোন কোন সময় তার রুমের দরজা দিয়ে প্রবেশ করেছিল সবই রেকর্ড আছে। সেই ভিডিও দেখে ৪ জন সন্দেহভাজন লোককে এখন জেরা করা হবে।
ঘটনাটি নিয়ে বেশ তোলপাড় হয়ে গেছে। দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকায়ও এসেছে খবরটা। তাই বাঘা বাঘা সব গোয়েন্দা নিয়োগ করা হয়েছে তদন্তে।
তুখোড় গোয়েন্দা আসিফ হায়দার এখন এ কেসের প্রধান। একথা অভিযুক্ত চারজনের অজানা নয়। আর এটা জানা আছে বলেই বুক ধুক ধুক আরো কিছুটা বেশি।
‘সিকান্দার আলী, এদিকে আসো।’ সন্দেহভাজনদের মধ্য থেকে একজনকে ডাকলেন গোয়েন্দা আসিফ হায়দার।
আদেশ পেতেই অল্পবয়স্ক একটা ছোকরা কাল চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে ভিডিও স্ক্রিনের সামনে চেয়ারে বসে পড়ল। সে এই হোটেলের সার্ভিস বয়।
‘বলেন স্যার।’ বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলবে যেনো।
‘ওকে, বলছি। আগে নিজের ভিডিও টা দেখো।’ বললেন গোয়েন্দা।
ভিডিওতে, সিকান্দার কে হাতে কফির ট্রে নিয়ে ভেতরে ঢুকতে দেখা গেল। মিনিট দুয়েকের মধ্যে বেরিয়ে এলো। করিডোর পারও হতে পারল না, এমন সময় বোমা বিস্ফোরিত হলো।
‘এবার বল কি বলতে চাও?’ গোয়েন্দার কঠিন চাহনী এবং তার চেয়েও কঠিন গলার স্বর শুনে এবার সত্যিই কেঁদে ফেললো সিকান্দার।
‘স্যার! আমি শুধু কফির ট্রেটা দিয়ে চলে আসছিলাম। কিভাবে যে বোমা ফাটল তার কিছুই জানিনা। অথচ লেখক স্যার সে সময় কি সুন্দর গান গাচ্ছিলেন।’
‘গান গাচ্ছিলেন?’
‘জি। বাইরে বের হচ্ছিলেন মনে হয়। কিছুটা আনমনে গান গাইতে গাইতে কোট পরছিলেন। পারফিউম খুঁজে পাচ্ছিলেন না। গানের ফাঁকে পারফিউম পারফিউম করে এদিক-সেদিক খুঁজছিলেন। আজ সকালেই স্যারকে পারফিউম টা উপহার দিয়েছিল দিলিপ সাহেব। তড়িঘড়ি করছিলেন খুব। স্যারের হাতে সিগারেট ছিল। একটা ছেঁকাও খেয়ে ছিলেন।’
‘ফালতু কথা না বলে আসল কথা বলো। রুমে কোনো বারুদের গন্ধ বা ঘড়ির জোরালো টিক টিক শুনেছিলে?’
‘না স্যার। তবে—’
‘তবে?’
‘ আমি কাছে ছিলাম বলে বিস্ফোরণের পর পর সবার আগেই রুমে ঢুকেছিলাম। দেখলাম স্যার ক্ষতবিক্ষত শরীরে মেঝেতে পড়ে আছে। সোফা, আসবাবপত্রের কিছুটা অংশ পুড়ে যাওয়া। তবে আফসোস! যে পারফিউম টা তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না, সেটা শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেয়েছিলেন। ওটাও বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল তার পাশে। বাপরে! কী যে বোমা ফেটেছিল কে জানে?’
‘কে জানে?’ মুচকি হাসলেন গোয়েন্দা আসিফ হায়দার।
তারপর কাল চেয়ারে বসে থাকা আরেকজনের দিকে তাকিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললেন, ‘হিল্লোল নবীশ, আপনিই মনে হয় সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন। অবশ্য আপনার চেয়ে ভালো বলবে আপনার ভিডিও। এদিকে আসুন।’
‘তো হিল্লোল নবীশ, আপনিও তো বোধহয় লেখালেখির জগতে পা দিয়েছেন। তাই না? দেরি না করে কাজের কথায় আসলেন আসিফ হায়দার। ‘
‘জি।’ আমশি মারা মুখ নিয়ে বললেন হিল্লোল নবীশ।
‘আমি কিন্তু আপনার ইন্টারভিউ নিচ্ছি না। জেরা করছি। খুনের মামলার জেরা। বুঝতে পারছেন? উত্তরগুলো যেনো নীট এন্ড ক্লীন হয়।’
‘জি হবে।’
‘তা ঘটনার দিন, মানে গত পরশু আপনি সুরেশ চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তার এজেন্ট রবি চ্যাটার্জি যা বললেন তাই বলছি আপনাকে— আপনি ঠিক সকাল সাড়ে ১১ টার সময় এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত কবি সুমন আশফাক। তিনি বেরিয়ে গেলেও আপনি রুমে থেকে যান। তিন মিনিট একা তার সঙ্গে কাটান। এর মাঝখানে একবার দরজার বাইরে আসেন। পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে পড়েন। তারপর আবার রুমে ঢুকে যান। আপনি বেরিয়ে যাওয়ার আধঘন্টা পরই তার রুমে বিস্ফোরণ হয় এবং তিনি মারা যান। ‘
হিল্লোল নবিশের ভিডিও চলছে। তিনি সত্যিই একবার বাইরে বেরিয়ে এলেন। পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ খুলে কি যেন পড়তে শুরু করলেন।
‘এই যে এখানে! সজীব এখানটায় ওই কাগজের লেখাটা আরো এনলার্জ করে দেখাও।’ এক্সপার্টের উদ্দেশ্যে বললেন গোয়েন্দা। আর সঙ্গে সঙ্গে চমকপ্রদ দৃশ্যটা দেখা গেল।
কাগজে হিল্লোল নবীশের আঙ্গুল এবং ওপরের দিকে আরও কিছু কাগজ থাকাই একটা লাইনই কেবল চোখে পড়ছে। তাও আঙুলের কারণে বেশ কিছু বর্ণ বাদ। প্রথম দিকে ‘হাউ টু’ তারপর কিছু বর্ণ আঙ্গুলে ঢাকা। তারপর একটা ইংরেজি এ এবং বি ও। দেখে যা বোঝা যাচ্ছে আসিফ হায়দার তা আরো সহজ করে দিলেন— ‘হাউ টু এক্সপ্লোর এ বোম্ব— তাই না মি. হিল্লোল?’
যার উদ্দেশ্যে বলা তিনি থ। কি বলবেন বুঝে উঠতে পারলেন না।
‘দরজার বাইরে এসে বম্বিং প্ল্যান টা দেখে নিয়েছিলেন। তাহলে এখন ঝটপট বলে ফেলুন কে আপনাকে পাঠিয়েছে সুরেশ চক্রবর্তী কে খুন করতে? কী এমন বোমা ব্যবহার করেছেন যে বারুদের গন্ধ বের হয় নি। বলুন?’ জোরালো কন্ঠে বললেন গোয়েন্দা।
‘আরে আশ্চর্য!’ এবার কথা বলার চান্স পেয়ে একেবারে চেতে উঠলেন হিল্লোল। ‘ওটা তারই লেখা একটা বইয়ের নাম ‘হাউ টু রিড এ বুক’। আপনি বুক কে বোম্ব বানিয়ে আমাকে ফাঁসাচ্ছেন? সুরেশ চক্রবর্তী কে অবাক করে দেবো বলে তার লেখা কয়েকটা বইয়ের নাম মুখস্ত করেছিলাম। বলার আগে একবার বাইরে এসে দেখে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম উনি খুশি হলে আমার লেখক জীবনে হয়তো এর কিছুটা প্রভাব পড়বে। উনি কিভাবে বোমা বিস্ফোরণে মারা গেছেন আমি জানি না। আমি নির্দোষ।’
‘সেটা প্রমানই বলবে। ঠিক আছে আপনি বসুন।’ বললেন গোয়েন্দা, তারপর যোগ করলেন,
‘জহরুল ভূঁইয়া, এবার আপনার পালা।’
এক ভদ্রলোক কাল চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে নির্ধারিত চেয়ারে বসলেন। তিনি একটি প্রকাশনীর মালিক। চুপচাপ নিজের ভিডিও দেখতে থাকলেন ভদ্রলোক।
সুরেশ চক্রবর্তীর রুমে তিনি পাঁচ মিনিট ছিলেন। তবে যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তখন দরজার কাছে তার রুদ্রমূর্তি এক আঙুল তুলে কেমন শাসানোর মত ভঙ্গি। উত্তেজিত ভাবে কিছু বলে হন হন করে হাঁটা দিলেন। স্ক্রীন অফ হয়ে গেলে নিজেই ঘুরলেন গোয়েন্দার দিকে ‘দেখুন, ভিডিওতে যা দেখা যাচ্ছে, তাতে আমাকেই খুনি হিসেবে সন্দেহ করা যায়। কিন্তু আমিই যে খুনি তার কী প্রমাণ? এটা ঠিক যে সেদিন ওনার সঙ্গে আমার কিছুটা কথা কাটাকাটি হয়েছিল। আমার প্রকাশনী কে একটা বই দেবেন বলেছিলেন। কিন্তু সেদিন একেবারে না করে দিলেন। এদিকে সব জায়গায় বিজ্ঞাপন দিয়ে অনেক টাকা খরচ করে বসে আছি। তাছাড়া বিজ্ঞাপন দিয়ে পরে বই বের করতে না পারলে পাঠকের কাছে আমার অবস্থানটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে একবার ভাবুন। যে কারণে অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত পারিনি। কিন্তু তার মানে এই না যে আমি তার রুমে বোমা রাখার ব্যবস্থা করেছি। এর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।
এরপর জেরা করা হলো দিলিপ কুমার কে। ভদ্রলোক ব্যবসায়ী। সুরেশ চক্রবর্তীর দেশী মানুষ। একই সঙ্গে হোটেলে উঠেছে দু জনে।
‘দিলিপ সাহেব, শুনেছি আপনার সঙ্গে চক্রবর্তী সাহেবের কিছু ব্যক্তিগত সমস্যা ছিল। তিনি মারা যাওয়ার আগের রাতে আপনাদের মধ্যে কোন একটা বিষয়ে তর্কাতর্কিও হয়। পাশের রুমের সজল সাহেব আপনাদের চিৎকারও শুনেছেন।’ বললেন আসিফ হায়দার।
‘আমাদের মধ্যে পারিবারিক বিষয়ে পুরনো একটা ঝামেলা আছে এটা সত্যি। আর সে রাতে ঐ বিষয় টা তুলতে চক্রবর্তী বেশ খেপেও গিয়েছিলেন। তবে তার কাছে আমি সকালেই মাফ চেয়ে নিই। দুপুরে একসঙ্গে লাঞ্চও করার কথা ছিলো। আর এই খুনের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নাই। আমি নির্দোষ।’ এই বলে থামলেন দিলিপ কুমার।
‘ঠিক আছে, আজ আপনারা যেতে পারেন। তবে পালানোর চেষ্টা করবেন না। বিশেষ বাহিনীর নজর থাকবে আপনাদের উপর।’ বললেন গোয়েন্দা।
আসিফ হায়দার কোনকিছু ভেবে কূল পেলেন না কে এই হত্যার জন্য দায়ী।
সমস্যা আরো বাড়লো যখন তিন দিন পার হয়ে গেলেও রিপোর্ট রেডি করতে পারলেন না। টেবিলে হাতের উপর মাথা রেখে কথাগুলো ভাবছিলেন, এমন সময় তাঁর সহকারী মারুফ রেহান এসে ঢুকলেন।
মারুফ রেহান ঢুকেই বললেন ‘স্যার, রিপোর্ট রেডি।’
আসিফ হায়দারের মুখে হাসির ঝিলিক। বলল ‘কে বোমা ফাটিয়েছিলো তারাতারি বল।’
‘কেউ না স্যার।’
‘ফাইজলামি করো আমার সাথে?’ বেশ রেগেই কথাটা বললেন আসিফ হায়দার।
কিছুটা থতমত খেলেও মারুফ রেহান নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন ‘স্যার, পুরো রিপোর্ট টা শুনলেই ক্লিয়ার হয়ে যাবে।’
‘ঠিক আছে, বলো।’
‘স্যার, রহস্যটা উদ্ধার হয়েছে সিকান্দারের জবানবন্দি থেকে। তার কথামতে ‘চক্রবর্তী সাহেব তড়িঘড়ি করছিলেন, হাতে সিগারেট ছিলো, পারফিউম খুজছিলেন এবং কিছুটা আনমনা হয়ে গান গাইছিলেন।’
আমার ধারনা ‘আনমনা অবস্থায় তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে পারফিউম টা যখন স্প্রে করে, তখনই স্প্রে গুলো সিগারেটের আগুনের স্পর্শ পেয়ে বোতল টা বিস্ফোরিত হয়েছে।’
আমার ধারণা টা শক্ত হয়েছে এটা শুনে যে, সিকান্দার কোন টিকটিক শব্দ শোনেনি। বিস্ফোরণের পর রুমে কোন বারুদের গন্ধও পায়নি। কিন্তু পারফিউমের বোতল টা বিদ্ধস্ত অবস্থায় দেখেছে।
এবং আমাদের ইনভেস্টিগেশনেও এমনই রিপোর্ট আসছে।
দিজ ইজ দ্য পয়েন্ট যেটার দ্বারাই ক্লিয়ার হয়ে যাচ্ছে যে, বোমা বিস্ফোরণ হয়নি। মূলত পারফিউমের বোতল টাই বিস্ফোরিত হয়েছে।
আসিফ হায়দারের রাগী মুখটা হাসিতে রূপ নিলো। কিছুক্ষন রিপোর্ট গুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা টা উঁচু করে মারুফ রেহান কে লক্ষ্য করে বললেন ‘প্রমোশন পাক্কা’।
শেষে এসে পুরো ঘটনাই পালটে গেল। থ্রিলার টাইপের একটা গল্প। অসাধারণ লিখেছেন।
শুভ কামনা।