আরাফাত শাহীন
এনায়েত আলীর হাতে একতাড়া নতুন টাকার নোট দেখা যাচ্ছে। সবগুলোই পাঁচশো টাকার। তা পঞ্চাশ খানার কম তো কিছুতেই হবে না। সুরমান আলী বারান্দায় বসে পড়ছিল। আর ক’দিন পরেই তাকে শহরে যেতে হবে কোচিং করার জন্য। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে মাত্রই। কোচিংয়ে যাওয়ার আগে নিজেকে একটু ঝালাই করে নিচ্ছে সে। সবাই অবশ্য পরীক্ষা শেষ করেই শহরমুখী হয়েছে। সুরমানও তাদের সাথে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। বাবা এনায়েত আলী টাকার যোগাড় করতে পারেননি এতদিন। আজ টাকাটা তিনি যোগাড় করে এনেছেন।
বাবার হাতে টাকার বাণ্ডিল দেখে সুরমান অবাক হয়ে গেল। এত তাড়াতাড়ি তিনি কীভাবে টাকা যোগাড় করে নিয়ে এলেন? ভারি আশ্চর্য ব্যাপার। সখিনা বেগম সকালের ভাত রান্না করার জন্য চাল নিয়ে বাইরে বের হচ্ছিলেন। স্বামীর হাসিমাখা মুখ এবং হাতে টাকার বাণ্ডিল দেখে তিনি অবাক হয়ে থমকে দাঁড়ালেন। তারপর তার চেহারায় রাগ এবং হতাশার একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ফুটে উঠল। তিনি জানেন এনায়েত আলী এই টাকা কীভাবে যোগাড় করে এনেছেন। সহসা রাগে ক্ষোভে সখিনা বেগমের গলা দিয়ে কোনো কথা বের হলো না। তারপর তিনি একটু ধাতস্ত হয়ে বললেন, ‘শেষ পর্যন্ত পালের একমাত্র গরুটাও বিক্রি করে দিলেন? এই গরুটার দুধ দিয়েই তো আপনার সংসার চলে। এখন চলবেন কীভাবে?’
এনায়েত আলী কিছুক্ষণ বোকার মত হাসলেন। এটা হলো তার স্বাভাবিক হওয়ার প্রক্রিয়া। তারপর তিনি বললেন, ‘তাই বলে ছেলেটার পড়াশোনা বন্ধ করে দেবো? সংসার যেভাবে হোক একভাবে চলবেই। অত চিন্তা করার কী আছে!’
‘আপনার মাথায় তো কোনো চিন্তাই নেই। যত চিন্তা সব তো আমার।’
রাগে-ক্ষোভে সখিনার মুখ বিকৃত হয়ে আসে। তারপর আবার যোগ করলেন, ‘একটা ছেলের জন্য না হয় টাকার যোগাড় করে নিয়ে এলেন। আর বাকিগুলোর কী হবে? তাদের পড়াশোনার খরচ চলবে কীভাবে?’
বাবামায়ের কথা শুনে একেবারে ছোট ছেলে সালমান বাবার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। এনায়েত আলী ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ‘আল্লাহ একটা ব্যবস্থা করেই দেবেন।’
সখিনা বেগম আর কথা বাড়ালেন না। বেলা ক্রমেই মাথার ওপর উঠে যাচ্ছে। রান্নার কাজটা তাকে দ্রুত সেরে ফেলতে হবে।
এনায়েত আলীর বড় সংসার। নিজে শিক্ষা লাভ করার সুযোগ একদমই পাননি। তবে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে তাকে বেশ সজাগ দেখা যায়। বড় ছেলে ওসমান আলী ম্যাট্রিক পাশ করার পর আর পড়তে পারেনি। এনায়েত আলী তাকে মাঠে কাজ করতে পাঠিয়ে দেন। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে এনায়েত তাকে সানন্দে কাজে পাঠিয়েছেন। বরং বাপের কষ্ট দেখে ওসমান নিজেই কাজে লেগে পড়ে। তা নাহলে এনায়েতের ইচ্ছা ছিলো ছেলেদের তিনি উচ্চশিক্ষিত বানাবেন।
এতবড় সংসার চালাতে এনায়েত আলীকে রীতিমত হিমশিম খেতে হয়। বড় ছেলে ওসমান গতবছর বিয়ে করে আলাদা হয়ে গিয়েছে। সে যতদিন একসাথে ছিলো এনায়েতকে তেমন কষ্ট সহ্য করতে হয়নি। তবে এনায়েত জানেন সুখের দিন চিরকাল কারও থাকে না। দুঃখ একদিন আসবেই। তাই তিনি নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, সুরমান একদিন তাকে সুখের মুখ দেখাবে। একবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে পারলে নিজের খরচ সে নিজেই চালাতে পারবে।
সুরমান আলীর যাওয়ার দিন এসে যায়। বেশ কয়েকদিন ধরে সে গোছগাছ করেছে। এই কয়দিন সখিনা বেগম তাকে বারবার বুঝিয়েছেন ভালোমত পড়াশোনা করা জন্য। তার বাবা যে তাকে অনেক আশা নিয়ে শহরে পাঠাচ্ছেন বারবার তাকে তিনি স্মরণ করিয়ে দিতে লাগলেন।
যাবার সময় উপস্থিত হলে সখিনা বেগম কিছুতেই নিজেকে সম্বরণ করতে পারলেন না। তিনি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। সেদিন গরু বিক্রি করে টাকা নিয়ে আসার পর তিনি যে রুদ্রমূর্তি ধরেছিলেন আজ তার ছিঁটেফোটাও নেই। আজ তিনি মমতাময়ী মায়ের বেশ ধরে হাজির হয়েছেন। সুরমানের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ‘ অচেনা জায়গায় যাচ্ছিস সবসময় সাবধানে থাকবি বাবা। সবকিছু ঠিকমত গুছিয়ে নিয়েছিস তো?’
‘নিয়েছি। তুমি অত চিন্তা করো না।’
‘তোদের নিয়েই তো আমার যত চিন্তা। সন্তানের জন্য মায়ের যে কী চিন্তা তা তোরা কীভাবে বুঝবি!’
সখিনার চোখে আবার পানি চলে আসে। তিনি আঁচলে মুখ ঢাকলেন। এই রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদলে লোকে কী বলবে!
সুরমানের ছোটভাই চার বছর বয়সের সালমান মনে করেছে তার ভাই চাকরি করার জন্য শহরে যাচ্ছে। সে ছুটে এসে ভাইয়ের জামা ধরে বলল, ‘আমার জন্য শহর থেকে নতুন জামা কিনে আনবে।’
সুরমান তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিলো।
বাড়ির সবাই এখানে উপস্থিত আছে। সুরমান সবার চোখে আশার ঝিলিক দেখতে পেল। সবাই তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে।
এনায়েত আলী ছেলের কাছে এগিয়ে এলেন। তারপর তার হাতে টাকাগুলো গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘সাবধানে রাখিস। মন দিয়ে পড়াশোনা করবি। টাকার জন্য কোনো চিন্তা করবি না। যখন যা লাগে বলবি।’
‘ঠিক আছে।’
ছোট্ট করে জবাব দিলো সুরমান।
‘দৈনিক একবার মোবাইলে কথা বলবেন কিন্তু। ‘
ছোটবোন জামিলা মিনতির সুরে বলল।
তার কথা শুনে সুরমান হেসে ফেললো।
সুরমান রওনা হয়ে গেল। শহরে মামার বাসায় তার থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে। সুতরাং চিন্তার কোনো কারণ নেই।
একমাস হলো সুরমান রাজশাহী শহরে এসেছে। এর মাঝে সে ভালো দেখে একটা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। সুরমান কোথাও তেমন একটা বের হয় না। কোচিং থেকে ফিরে এসে সারাদিন রুমে বসে পড়ে। ওর কয়েকজন বন্ধুও এখানে কোচিং করতে এসেছে। তারা প্রায়ই পদ্মার তীরে ঘুরতে বের হয়। সুরমানকে বেশ কয়েকবার যেতে বলেছে। সে সোজা না করে দিয়েছে। এখানে সে পড়াশোনা করার জন্য এসেছে ঘুরে বেড়াবার জন্য নয়।
মামা একদিন বললেন, ‘তুই তো কোথাও বের হোস না। আজ বিকেলে গিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেখে আয়। ভালো লাগবে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে সেখানে পড়ার প্রতি অন্যরকম একটা আগ্রহ তৈরি হয়।’
সুরমান একমনে তার বায়োলজি বইয়ের পাতায় কলম চালাচ্ছিল। এভাবে বই দাগিয়ে পড়লে তার পড়া বেশি মনে থাকে।
মামার কথা শুনে সে চোখ তুলে তাকাল। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে। আমিও তাই ভাবছিলাম। কোথাও গেলে একটু ভালোও লাগবে। আমি বিকেলেই যাচ্ছি।’
মামা অফিসের জন্য বের হয়ে গেলেন। সুরমান আবার বইয়ের পাতায় কলম চালাতে লাগল।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সুরমান একেবারে চমকে গিয়েছে। এর আগে সে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় দেখার সুযোগ পায়নি। একটা বিশ্ববিদ্যালয় এতটা সুন্দর হতে পারে সে কখনও কল্পনা করতে পারেনি। এতদিন সে জেনে এসেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানে হলো স্রেফ কয়েকটা বিল্ডিং, এর বেশি কিছু নয়। এমন সাজানো গোছানো প্রাকৃতিক নৈঃসর্গিক দৃশ্য দেখে সত্যিই তার পাগল হওয়ার দশা। তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেই হবে- এই সংকল্প নিয়ে সে প্যারিস রোড জুড়ে সারা বিকেল হেঁটে বেড়ালো। একটা রাস্তা এত সুন্দর হয় কী করে!
সন্ধ্যা নামার ঠিক আগ মুহূর্তে সে মেইন গেটে এসে দাঁড়াল। এবার তাকে আটোরিকশায় করে শহরের দিকে ফিরতে হবে। যাবার আগে সে মেইন গেট দিয়ে সোজাসুজি প্রশাসনিক ভবনের দিকে তাকাল। মাঝখানে নান্দনিক জোহা চত্বর তার চোখ দু’টি জুড়িয়ে দিয়ে গেল। যদিও সে জানে না এটা কী।
সুরমানের আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় কয়েকজন ছেলে ভেতর থেকে দৌঁড়ে বের হয়ে এলো। তারপর সন্ধ্যার অন্ধকারে তারা অদৃশ্য হয়ে গেল। সুরমান এসবের কিছুই খেয়াল করল না। হঠাৎই দশ-বারোজন ছেলের একটা দল তাকে ঘিরে ধরল। ইতোমধ্যে মেইন গেট ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। একটা গোলমালের আঁচ পেয়ে সবাই নিরাপদ স্থানে সরে গিয়েছে। দলের একজন বলে উঠল, ‘ভাই, এই ছোকরা ওদের সাথে ছিল। আমি নিজের চোখে দেখেছি।’
‘মার শালাকে।’
একসাথে গর্জে উঠল সবাই। সুরমান প্রতিবাদ করার সময়টুকুও পেল না। একসাথে হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ল তারা। রামদায়ের কতগুলো কোপ যে তার গায়ে পড়ল তার হিসাব কেউ রাখল না। ততক্ষণে সুরমান লুটিয়ে পড়েছে রাস্তার মাঝখানে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দ্বারা নিহত হয়ে ড. জোহা যেখানে লুটিয়ে পড়েছিলেন তার কিছুটা দূরে সুরমানের লাশ ফেলে হত্যাকারীরা পালিয়ে গেল। ততক্ষণে পুলিশের গাড়ির সাইরেন বেজে উঠেছে।
মাঝরাতে সুরমানের মৃত্যুর খবর তার বাড়িতে এসে পৌঁছালো। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে কাঠ হয়ে ছিল। সংবাদ শুনে সখিনা বেগম একটা চিক্কুর পেড়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। এনায়েত আলী বোবা মানুষের মত ঘরের খুঁটি ধরে বসে রইলেন। তার নড়ার শক্তিও নেই। ঘন্টাখানেক পর গ্রামের লোকজন যখন সখিনা বেগমের জ্ঞান ফেরানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে ততক্ষণে সুরমানের লাশ রাজশাহী থেকে গ্রামের পথে রওনা হয়ে গিয়েছে।
আরাফাত শাহীন
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
মানুষের স্বপ্ন সত্য করার জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়। কিন্তু, এই স্বপ্ন ভেঙ্গে যেতে কোনো সময় লাগে না। নিমিষেই স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়। যেমনটা সুরমান ও তার পরিবারের সাথে হয়েছে। বানান ভুল তেমন চোখে পড়েনি।
পরিশেষে বলতেই হয়, লেখকের লেখা ধরন অনেক উন্নত।