নাঈমুল ইসলাম গুলজার
আজরফ আলী।বৃদ্ধ। বয়সের ভারে হাঁটতে পারেন না।জীবনের এই ক্রান্তিলগ্নে এসে জীবনটাকে বৃথা মনে হচ্ছে।বৃথা এ সংসার গড়েছেন।বৃথা ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করেছেন,সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।শেষবেলার ভাবনাটা যদি প্রথমেই আসতো তাহলে এসব কিছুই করতেন না।
___
তখন ভেবেছিলেন,ছেলে হয়েছে।ছেলেকে মানুষ করতে হবে।মানুষ করতে হলে পড়াতে হবে।পড়িয়েছিলেন,দেশের নামকরা স্কুলেই ছেলেকে পড়িয়েছিলেন।স্কলারশিপ পেয়েছিল।তাই উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশও পাঠিয়েছিলেন।সেখান থেকে ফিরেছিলো উচ্চশিক্ষিত হয়ে।বংশের মুখ আলো করে।
গর্বে ভরে গিয়েছিল আজরফ আলীর বুকটা।
___
ছেলে বিদেশ থাকার সময় সন্ধ্যাবেলা যখন বাজারে আড্ডা দিতে যেতেন।তখন জোয়ান-বুড়ো সবাই তাকে ঘিরে ধরতো।ছেলে কেমন আছে তা জিজ্ঞেস করতো।চিঠি আসে কিনা তাও জিজ্ঞেস করতো।সবাই গর্ব করে বলতো,”আজরফ আলী ছেলেকে মানুষ বানাচ্ছে”।
আজরফ আলী মনে মনে খুশি হতেন কিন্তু মুখে গাম্ভীর্য এনে বলতেন,”ছেলে আমার একটা।তাকে তো মানুষ করতেই হবে।তা না হলে বড় হয়ে বলবে,বাবা আমার জন্য কিছুই করেন নি”।সবাই ঠিক ঠিক বলে উঠতো।
___
ছেলে দেশে এসেছিলো।নিজ গ্রামে এসেছিলো।ছেলে-বুড়ো সবাই উৎসুক হয়ে আজরফ আলীর বাড়িতে ভীড় করেছিলো উচ্চশিক্ষিত বিদেশ ফেরত ছেলেকে দেখার জন্য।আজরফ আলী বারান্দায় বসে উঁচু আওয়াজে সবাইকে বলেছিলেন,ছেলে আমার বিদেশ-ভুঁইয়ে থেকে এসেছে।ক্লান্ত মানুষ,বিশ্রাম দরকার।পরে সবাই এসে দেখা করো।
সবাই ভাবলো ঠিকই তো! ক্লান্ত মানুষ।আমরা তার সাথে পরেই দেখা করবো।ফিরে গিয়েছিলো সবাই।
___
দিন কয়েক পরের কথা।আজরফ আলীর ছেলে তাকে বললো,”গ্রামের এই ছোটলোকদের সাথে সে থাকতে পারবে না।তাই সে শহরে চলে যেতে চায়”।
শুনে আজরফ আলী আঁৎকে উঠলেও পরক্ষণে ভাবলেন,ঠিকই তো! গ্রামের সবাই মূর্খ মানুষ।এদের সাথে চলাফেরা করলে আমার উচ্চশিক্ষিত ছেলেটাও মূর্খ হয়ে যাবে। এর একটা বিহিত করতে হবে।
___
আজরফ আলী গ্রামের সব সম্পত্তি বিক্রি করে শহরে আলিশান বাড়ি বানালেন।শহরই হবে এখন তার ঠিকানা।
শহরে এসে ছেলের একটি বড় কোম্পানিতে চাকরি হলো।
দিন কাঁটছিলো সুখেই।
___
একদিন আজরফ আলীর স্ত্রী অসুস্থ হলেন।বড় অসুখ।
হাসপাতালে ভর্তি।বেশিক্ষণ হয়তো বাঁচবেন না।হাসপাতালে সবাই ঘিরে রয়েছে তাকে।মারা গেলেন তিনি।মরার আগে ছেলেকে বিয়ে দেওয়ার জন্য অসীয়ত করে গেলেন।
___
দিন কয়েক পার হলো।শোক এখনো কাঁটিয়ে উঠতে পারেন নি।আজরফ আলী চিন্তা করলেন,এভাবে থাকা যায় না।স্ত্রীর শেষ অসীয়ত পালন করতে হবে।কনের খোঁজ করতে হবে।
আজরফ আলী সব জায়গায়ই খোঁজ লাগালেন।উপযুক্ত পাত্রী পেলেন না।
___
এদিকে আজরফ আলীর ছেলে তার পছন্দের পাত্রী আছে বলে জানালো।আজরফ আলীর পাত্রীকে পছন্দ হয়নি।কিন্তু ছেলের পছন্দ বলে মেনে নিলেন।
বিয়ে হলো।
আজরফ আলী ভাবলেন,এবার ছেলের সুখ দেখে দেখে দিন কাঁটিয়ে দিবেন।
___
দিন চলছিলো।
এদিকে আজরফ আলীর শরীরে নানা রোগ বাসা বেঁধেছে।আগের মতো চলতে-ফিরতে পারেন না।এক সময় বিছানায় পড়ে গেলেন।হাঁটতে কষ্ট হয় তার।
___
ছেলের বউ প্রথম দিকে তার সেবাযত্ন করলেও আস্তে আস্তে তার পরিমাণ কমতে থাকলো।ছেলের সাথে তো সারাদিনে একবারই দেখা হয়।শুধু অফিসে যাওয়ার সময়।এছাড়া আর দেখা হয় না।
ছুটির দিন আসলে ছেলে আর ছেলের বউ বেড়াতে যায়।তাই ছুটির দিনেও দেখা হয়ে উঠে না।কথা বলা হয়ে উঠে না।
এদিকে আজরফ আলী অধীর আগ্রহে বসে থাকেন,ছেলে এসে তার সাথে কথা বলবে বলে।
___
একদিন ছুটির দিন ছেলে এসে বললো,”বাবা,কালকে আমরা এক জায়গায় যাবো”।
আজরফ আলী মনে মনে খুশি হন ছেলের সাথে বেড়াতে যাবেন বলে।কোথায় যাবেন সেটা আর জিজ্ঞেস করেন না।
আজরফ আলী দেখলেন,ছেলে এবং বউমা সবাই তার সেবায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ছে।ভালো ভালো খাবার রান্না করছে।তার সেবা-শুশ্রূষা করছে।তিনি বুঝলেন না কিছু।
___
পরদিন সকালে,
ছেলে এবং বউমা মিলে আজরফ আলীর কাপড় গোছাচ্ছেন।
আজরফ আলীর বুকে অন্যরকম একটা মোচড় দিয়ে উঠলো।কি হচ্ছে এসব!
ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,কাপড় গোছাচ্ছো কেন? ছেলে কিছু বললো না।বউমাকে বলতেই কথার উপরেই বলে উঠলো,”আপনাকে আমরা পালতে পারবো না তাই বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিচ্ছি”।
আজরফ আলী বাকরূদ্ধ হয়ে পড়লেন।ছেলে তাকে এখানে না রেখে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিচ্ছে? সে আমার সেবা করতে পারবে না? আমাকে এখানে রাখতে পারবে না? তাহলে কেন লালন-পালন করেছি তাকে? এত এত পড়ে কি শিক্ষা পেলো সে?
আজরফ আলী ছেলের কাছে একটি রাত থাকার জন্য আবদার করলেন,পরে তারা যেখানে নিয়ে দিবে সেখানেই থাকবেন এই বলে।
___
রাত গভীর হলো।
আজরফ আলী ভাবছেন,ছেলেকে সবরকমের শিক্ষা দিয়েছিলেন কিন্তু সুশিক্ষাটা দিতে পারেন নি।যার ফল আজ তিনি হাতেনাতে পাচ্ছেন।
আজরফ আলীর একা মনে হতে লাগলো নিজেকে।গ্রামের কথা মনে পড়লো।গ্রামে কোনো ছেলে তার পিতাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসে না।আজরফ আলী সিদ্ধান্ত নিলেন,ছেলেকে বলে গ্রামে চলে যাবেন,বৃদ্ধাশ্রমে নয়।গ্রামের সবাইকে বলবেন,সন্তানকে আর কিছু নয়,আগে যেন শিখায় কোরানের সেই শাশ্বত বাণী…”ওয়াবিল ওয়া লিদাইনি ইহসানা”।শিখায় যেন এই দোয়া…”রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বায়ানী সাগীরা”।এসব করে কেঁটে যাবে দিন।গ্রামের মাটি মেখে তার মৃত্যু হবে।
___
আজরফ আলীর পিপাসা পেলো।
ছেলেকে ডাক দিতে চাইলেন।কিন্তু ডাকলেন না।এতরাতে ছেলের ঘুম ভাঙতে চাইলেন না।দুর্বল পায়ে উঠে দাঁড়াতে চাইলেন।কিন্তু পারলেন না।বিছানার পাশে জগ থেকে পানি খেলেন।
আবার শুয়ে পড়লেন।তবে সাময়িক নিদ্রায় নয়।চিরনিদ্রায়।আজরফ আলী বৃদ্ধাশ্রমে গেলেন না।আজরফ আলী গ্রামেও গেলেন না।জীবনের শেষ লগ্নে অকল্পনীয় পরিণতি দেখে চলে গেলেন অপার জগতে।মাওলার কাছে………
খুব সুন্দর গল্প । ভালো লেগেছেব । শুভকামনা♥
সমাজের কঠিন বাস্তবতা ফুঁটে উঠেছে এই গল্পে। বাব-মা অনেক কষ্ট করে সন্তানদেরকে বড় করে, তাদেরকে শিক্ষিত করে। কিন্তু ফলস্বরুপ তাদের সন্তান তাদেরকে বৃদ্ধ বয়সে বৃদ্ধশ্রমে পাঠিয়ে দেয়।অনেক সুন্দর একটা গল্প।
— বিরাম চিহ্নের পর স্পেস ব্যবহার করতে হয়।
করেন নি — করেননি (নি সবসময় শব্দের সাথে যুক্ত হয়)।