লেখাঃ মেহেদী হাসান হাসিব
বিরল এক রোগের কারণে চার হাত-পায়ের অনুপস্থিতিতে তাঁর জন্ম হয়। জন্মের পরই তাঁর মা তাঁকে গ্রহণ করতে চাইনি কারণ সে হাত-পা বিহীন। তারপর অনেক ঝঞ্ঝাট পেরোনোর পর তাঁরা তাঁকে মেনে নেয় ইশ্বরের দান ভেবে। তিঁনি ছোট বেলায় সবসময় হতাশ থাকতেন। কারণ তার কোন খেলার সঙ্গী ছিলো না। শুধু মাত্র বিকলাঙ্গ হওয়ায় অন্য বাচ্চারা তাঁর কাছ থেকে দূরে থাকতো। মোট কথায় তিঁনি এক নিঃসঙ্গ জীবন অতিবাহিত করতেন। তাঁর সহপাঠী ও সমবয়সীরা পায়ে ভর দিয়ে দৌঁড়াতো, খেলতো, নাচতো, ছুটতো, সাঁতার কাটতো। কিন্তু এর কোনকিছুই যখন সে করতে পারতো না, তখন সে মনস্থির করলো এই জীবন যখন অন্য জীবনের মতো চলবে না তখন এই জীবনকে সে মুক্তি দিবে। মাত্র ১০ বছরে বয়সে সে বাথটাবে আত্নহত্যার চেষ্টা করে বিফল হয়। এভাবে আরো দুইবার তিনি আত্নহত্যার চেষ্টা করেন কিন্তু তৃতীয়বারে সে তাঁর জীবনের মূল্য বুঝতে পারে।
যখন সতেরো বছর বয়স, তাঁর মা ভুরিসলাভ ভুজিসিক তাঁর মতো আরেক শারীরিক অক্ষম ব্যক্তির একটি গল্প তাঁকে শোনায় যা তাঁর জন্য শ্রেষ্ঠ এক অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করে। গল্পে—লোকটি অন্ধ ছিলো। অন্ধ লোকটি যিশুকে প্রশ্ন করে কেন তাঁকে অন্ধ বানানো হলো। যিশু প্রতিত্তরে বলল, অন্ধের মাঝে সৃষ্টিকর্তা তার কাজকে প্রকাশিত করবে। তারপর থেকে তাঁর মাঝে অনুপ্রেরণা জন্ম নেয়। তিঁনি শুরু করে দেন তার ভাগ্য পরিবর্তন। নিজেই লিখে চলেন নিজের ভাগ্য।
তাঁর হাত পা না থাকলেও ছিলো এক দক্ষতা। তিনি শরীরকে বাকিয়ে চলাফেরা করেন, অনেকটা শামুকের মতো। প্রথমে মাথাকে ভূমিতে ঠেকান তারপর শরীরকে ভাজ করে সামনে এগোন।
হাত-পা না থাকলেও তাঁর শরীরে নিচের অংশে দুটি আঙ্গুল বেড়িয়েছিল। সেই অঙ্গ দিয়ে কলমকে এক প্রক্রিয়ায় ধরে তারপর তিঁনি লিখে থাকেন। তিঁনি এই দুই আঙ্গুল দিয়ে প্রতি মিনিট ৪৭ টি শব্দ টাইপ করতে পারেন। আমাদের সাধারনত একবার গ্রাজুয়েশন সম্পূর্ণ করতেই বেহাল অবস্থা হয়ে যায়। আর দ্বিতীয়বার অন্য বিষয়ে গ্রাজুয়েশন আমাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব মনে হয়। অথচ তিঁনি দুই আঙ্গুল নিয়ে দুই বিষয়ে গ্রাজুয়েশন করেছেন। তিঁনি অর্জন করেছেন ডাবল ব্যাচেলর হিসাব বিজ্ঞান ও ব্যবসায় পরিকল্পনায়। ইচ্ছাশক্তি আর আপ্রাণ চেষ্টা ছাড়া যা কখনো সম্ভব ছিলো না। তিঁনি একাধারে অস্ট্রেলিয়ান খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারক, অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তা, লেখক, অভিনেতা। তিনি ৫৩ বার বাদ হওয়ার পর প্রথম বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ পান। বক্তৃতার মঞ্চে ১০০০ জন শ্রোতার মধ্য থেকে একে একে ৯৯০ জন উঠে চলে যান শুধু মাত্র ১০ জন শ্রোতা ছাড়া। কিন্তু তিঁনি এই পর্যন্ত দেশ ও বিদেশ ঘুরে কমপক্ষে ৩০ লক্ষ লোককে স্বশরীরে অনুপ্রাণিত করেছেন। তাঁকে শিশুকাল থেকেই মানসিক ও দৈহিকভাবে সংগ্রাম করতে হয়েছে। নিজের প্রতিবন্ধত্বকে জয় করে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি বিকলাঙ্গদের নিয়ে কাজ করার জন্য ‘লাইফ উইথআউট লিমবস’ নামে নিজের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান শুরু করেন এবং পরবর্তীতে মোটিভেশনাল স্পিকিং কোম্পানি ‘অ্যাটিচ্যুড ইজ অ্যাটিচুড’ প্রতিষ্ঠা করেন।
তিঁনি আর কেউই না তিঁনি আপনাদের সবার প্রিয় ব্যক্তি ও ভালবাসার মানুষ নিক ভুইয়টসিক। যিনি একাধারে একজন অস্ট্রেলিয়ান খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারক, অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তা, লেখক, অভিনেতা। অত্যন্ত বিরল ‘ফুকামেলিয়া’ রোগে আক্রান্ত হয়েও নিক বর্তমানে দুই সন্তানের বাবা। তিঁনি লাভ ম্যারেজ করেছেন। তিঁনি অন্তত সাতান্নটি দেশ ভ্রমণ করে চারশো মিলিয়ন মানুষকে স্বশরীরে থেকে অনুপ্রেরণা দানকারী একমাত্র গর্বিত বক্তা। তাঁর ‘লাইফ উইদাউট লিমিটস’, ‘লাভ উইদাউট লিমিটস’, ‘স্ট্যান্ড স্ট্রং’, ‘লিমিটলেস’ এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার ‘আনস্টপ্যাবল’ নামক বইগুলো আজ বিশ্বব্যাপী প্রায় ত্রিশটি ভাষায় অনুদিত প্রকাশিত হয়েছে।
এক সাক্ষাতকারে তাঁর এমন বিকলাঙ্গতা সম্পর্কে তাঁর স্ত্রীকে প্রশ্ন করা হলে,‘‘আপনার যদি ছেলে হয়, তাঁদেরও যদি হাত পা না থাকে, তাহলে কী করবেন?’’ তিনি প্রতিত্তরে বলেছিলেন,‘‘আমি তাঁকে আরেকটি ভুইয়টসিক বানাবো।’’
নিক ভুইয়টসিকের দৃষ্টিতে জীবন খুব সহজ, সরল ও স্বাভাবিক। স্রষ্টায় বিশ্বাসী এই অসাধারণ ব্যক্তিটি তার এমন অস্বাভাবিক শারীরিক অসংলগ্নতার জন্য কখনোই স্রষ্টাকে দ্বায়ী করেনি। খুব স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দেন, “আপনার খারাপ হবে ঈশ্বর আপনার জীবনে এমন কিছু ঘটতে দেবেন না। ইশ্বর যা করে ভালোর জন্য করে।” তিঁনি আরো বলেন, ‘‘প্রায়শই লোকে আমাকে জিজ্ঞেস করে হাত-পা না থেকেও আমি কিভাবে সুখী হতে পারি। দ্রুত করেই উত্তর দিয়ে ফেলি যে, আমার কাছে একটি পছন্দ আছে। হয় আমার এমন অবস্থার জন্য আমি রাগ হতে পারি না হয় কৃতজ্ঞ হতে পারি। আমি বরাবর কৃতজ্ঞতা বেছে নেই।’’
তিঁনি যা আছে তা নিয়ে স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করার কাজে নিজেকে সবসম নিয়োজিত করে এগিয়ে যাওয়ায় বিশ্বাসী। সবার মতো প্রতিযোগিতায় তিঁনিও থেমে না থেকে বারবার হেরে যাওয়ার পরেও আবার চেষ্টা করে যাওয়ায় বিশ্বাসী। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, “যদি আমি ব্যর্থ হই, আমি আবার চেষ্টা করি এবং বারবার চেষ্টা করি। যদি আপনি ব্যর্থ হন, আপনি কি আবার চেষ্টা করেন? মানুষের মানসিকতা বাস্তবতার থেকে চরম খারাপকেও সামলে নিতে পারে। আসল ব্যাপার সে কিভাবে শেষ পর্যন্ত নেয়। সে কী শেষ পর্যন্ত শক্তভাবে সবকিছু সামলে নেয়?”
তাঁর কিছু জনপ্রিয় উক্তি,
– প্রায়ই আমরা মনে করি আমরা এই পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে পারবো না, অথবা আমরা মনে করি যে এটি কোনদিন কোনভাবেও পরিবর্তন করা সম্ভব না। কিন্তু সত্য হলো আপনি কারো দিনকেই পরিবর্তন করতে দিতে পারবেন, কারো জীবনকে। কিন্তু আপনাকে দেখাতে হবে আপনি আসলে কী করতে পেরেছেন যা থেকে আশানুরুপ ফল চান।
– আমি কারো জীবনের ঘৃণার কারণ হতে চাইনা, আমি চাই কারো জীবনের কিছু প্রার্থনার কারণ হতে।
– অর্থ আপনাকে ভালো রাখতে পারে না। অর্থ আপনাকে সফলতা এনে দিতে পারে না। আমার হাত-পায়ের দরকার নেই, আমার চাই সফলতা। আমার হাত-পায়ের দরকার নেই, আমার চাই শান্তি। আমার হাত-পা চাই না, অন্য কারো জীবনের অলৌকিক ঘটনার কারণ হতে চাই।
– যত বড় সংগ্রাম তত মহিমান্বিত বিজয়।
– আপনার জীবনে একটি পছন্দ আছে। তেতো অথবা ভালো। ভালোকে বেছে তেতো ভুলে যান।
– আপনার ছেলে এবং আপনার মেয়ের একটি চমৎকার স্কুলে-কলেজের চেয়ে আরো একটি চমৎকার বাবা প্রয়োজন।
– আপনি ভাবছেন যে আপনি যথেষ্ট ভালো নন, এটা মিথ্যা। আর এটাও মিথ্যা ভাবনা যে আপনি কোনরকম মূল্যবান না।
তরুণ প্রজন্ম হতে বৃদ্ধ পর্যন্ত অনেককিছু শেখার আছে এই মহান ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে। তিঁনি শ্রেষ্ট এবং অন্যতম কিংবদন্তীর একজন। এবং তিঁনি আমাদের জন্য শ্রেষ্ঠ অনুপ্রেরণা। আমাদের শারীরিক সক্ষমতা আছে শুধু তাই নয় আমরা চাইলে তাঁর থেকে বেশি করতে পারি। হাত-পায়ের অনুপস্থিতিতে তিঁনি যখন বিশ্বমানবকে তাক করে দেখাতে পারেন। তবে আমরা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েও কেন পারবো না? অবশ্যই আমাদের এই মহান কিংবদন্তীকে অনুসরণ করতে হবে।
০ Comments