সাখাওয়াত আলী
মাথার ভিতর আবার সেই যন্ত্রণাটা শুরু হলো। খুবই অসহ্য রকমের যন্ত্রণা। প্রথমে মাথার বা পাশ থেকে ব্যথাটা শুরু হয়। তারপর আস্তে আস্তে ব্যথাটা ঘাড় পর্যন্ত নেমে আসে। তবে ব্যথাটার একটা ভালো দিক আছে। ব্যথাটা নিয়মিত হয় না, দু’তিন দিন পরপর শুরু হয়। প্রথম যখন রোগটা ধরা পড়ে তখন ডাক্তারাও খানিকটা অবাক হলেন। কারণ এমন রোগ আগে কখনো দেখেন নি তারা। অনেক পরিক্ষা-নিরিক্ষা করার পর বললেন, এখানে এ রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব হবে না। তারপর তারা এ রোগের চিকিৎসার জন্য রুগিকে আমেরিকা ট্রান্সফার করলেন। সেখানে বহুদিন পরিক্ষা-নিরিক্ষার পর ধরা পড়লো রোগীর স্নায়ু ক্যানসার, যার চিকিৎসা পৃথিবীতে অনেকটাই দূর্লভ।
জনাব আজগর সাহেব চোখ দুটি বন্ধ করে হেলান দিয়ে তাঁর ইজি চেয়ারটায় বসে আছেন। ব্যথা উঠলে তিনি এভাবেই চুপচাপ এই চেয়ারটায় বসে থাকেন। তখন তাকে কেউ ডিস্টার্ব করে না। অবশ্য ডিস্টার্ব করার মত কেউ নেই বাড়িতে। ৪-৫ জন চাকর-বাকর বাদে আর কেউ থাকে না। আজ ২ দিন হলো তাঁর স্ত্রী মারা গিয়েছে। বলার মত তেমন কোনো রোগ ছিলো না মতিয়া বেগমের। সুস্থ-সবল, স্বাভাবিক একজন মানুষ হঠাৎ একটা স্ট্রোকে নিস্তেজ হয়ে পড়লেন। হাসপাতালে নেয়ার আগেই মাঝ রাস্তায় তিনি মারা যান। মতিয়া বেগমের এভাবে চলে যাওয়া আজগর সাহেবকে আরো একা করে দিলো। এখন শোকের ছায়া বিরাজ করছে এই বাড়িটিতে।
সাহেব, ‘উকিলবাবু এসেছেন।’
আজগর সাহেব হাতের ইশারায় তাকে ভিতরে আসতে বললেন। নিয়ামত হোসেন আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকে একটি চেয়ারে বসলেন। আজগর সাহেব চোখ বন্ধ অবস্থায়ই উকিলকে জিজ্ঞাসা করলেন,’কি অবস্থা উকিল? এবার জামিন হবে?’
‘আল্লাহ রহমতে হয়ে যাবে স্যার।’
‘সেটা তো অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন,কিন্তু জামিন তো হচ্ছে না। ‘
‘মার্ডার কেস তো স্যার,একটু সময় লাগবে। আগের বার হাতে তেমন এভিডেন্স ছিলো না। তবে এবার জোগার করেছি। অনেকগুলো মিথ্যা সাক্ষীর ব্যবস্থা করেছি। এবার হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।’
‘হুম, তবে এবার আমি আমার ছেলের জামিন দেখতে চাই। তার জন্য যত টাকা খরচ করতে হয় করেন।’
‘ইনশাআল্লাহ, এবার জামিন হয়ে যাবে ।’
‘হুম। এখন যান, আমি রেষ্ট নিবো। আর হ্যাঁ, সম্পত্তির উইলগুলো রেডি করেছেন?’
‘জ্বি স্যার, করেছি । দেখবেন ?’
‘নাহ্, আজ দেখবো না। মাথায় আবার সেই ব্যথাটা শুরু হয়েছে। আপনি এখন যান।’
নিয়ামত হোসেন অতি ভদ্রতার সহীত রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।
আজ পত্রিকায় বড় করে হেডলাইন এসেছে ‘ টাকার কাছে কি আইন নত হবে!’আজগর সাহেব পত্রিকাটি হাতে নিয়ে হেডলাইনটি পড়লেন। লেখাটি পড়েই তাঁর মাথায় রক্ত চড়ে গেলো। ‘কি সব আজেবাজে কথা! মনে হচ্ছে পত্রিকার লেখকদের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। ইদানিং যাচ্ছে তাই ভাবে লিখে যাচ্ছে তাঁর নামে। বিষয়টা মোটেও ভালো নয়।
সময় থাকতে তাদের থামাতে হবে নয়ত একদিন বিশাল কিছু লিখে বসতে পারে তারা।’
আগজর সাহেব নিজেকে সামলাতে তাঁর বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগলো। তারপর আস্তে করে পত্রিকাটি টেবিলের উপর রেখে দিয়ে আবার তাঁর সেই চেয়ারটায় হেলান দিলেন।
‘করিম।’
‘জ্বি, সাহেব।’
‘নিয়ামত বাবু কি এসেছেন?’
‘জ্বি সাহেব। উনি অনেকক্ষণ ধরেই নিচে বসে আছেন। আপনি ঘুমুচ্ছিলেন তাই আর আপনাকে ডাক দেই নি।’
‘ঠিক আছে, তুমি যাও।’
আজ সকাল ৯টায় কোর্টের টাইম। আজই তাঁর ছেলের চূড়ান্ত রায় হবে। যে করেই হোক আজ তাকে তাঁর ছেলের জামিন করাতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতেই আজগর সাহেব রেডি হওয়ার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন।
ঘড়িতে সকাল ৯টা। কোর্টের ভিতর অসংখ্য মানুষের ভিড়। সবার ভিতরই এক ধরণের চাপা কৌতুহল কাজ করছে। কী হবে আজ! কী রায় আসবে! আজগর সাহেব উকিলের ঠিক পিছনের চেয়ারটায় বসে আছেন। জজ ঢুকার সাথে সাথেই সবাই উঠে দাঁড়ালো। তারপর জজের অনুমতিতে কোর্টের কার্যক্রম শুরু হলো। নিয়ামত সাহেব তাঁর এভিডেন্সগুলোতে একপাট্টি চোখ বুলালেন। তারপর একের পর এক মিথ্যা সাক্ষী পেশ করতে লাগলেন।। মিথ্যাকে সত্য করার জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। সরকারি পক্ষের উকিলও তার বিভিন্ন এভিডেন্স পেশ করে যাচ্ছে। নানা এভিডেন্স, নানা সাক্ষী বিচার-বিশ্লেষণ করার পর জজ আসামীকে দোষী সাব্বস্ত করে তাকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিলো। জজের রায় শুনে আজগর সাহেব একদম চুপ হয়ে পড়লেন। নিয়ামত হোসেনও জজের রায়ে অনেকটা অবাক হলেো। ব্যর্থতার গ্লানী মুছার জন্য নিয়ামত হোসেন তাঁর মাথাটি নিচু করে বসে রইলো।
কোর্টের বাহিরে হাজারো লোকের ভিড়। অসংখ্য মানুষ ভিড় জমিয়েছে সেখানে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল থেকে রিপোর্টাররা
এসেছে, তারা অনবরত রিপোর্ট করে যাচ্ছে। আজগর সাহেব এবং তার উকিল কোর্ট থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই রিপোর্টাররা তাদের ঘিরে ফেললো। নানান ধরনের প্রশ্ন করে যাচ্ছে রিপোর্টাররা। নিয়ামত হোসেনও শক্তভাবে তাদের প্রশ্নের জবাব দিয়ে গেলেন। সবার শেষে তিনি রিপোর্টারদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমার মক্কেল নির্দোষ। তাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে। আমরা হাই কোর্টে তার জন্য আপিল করবো। ইনশাআল্লাহ, আমাদের জয় হবেই।’ নিয়ামত হোসেনের কথা শুনে আজগর সাহেবের মনটা আরোও খারাপ গেলো। তিনি জানেন, আর যতই চেষ্টা করা হোক না কেনো তাঁর ছেলেকে তিনি মুক্ত করতে পারবেন না। জীবনে তিনি অনেক অন্যায় করেছেন। সেই অন্যায়ের প্রতিদান তিনি আজ ভোগ করছেন। চারদিক থেকে বিক্ষুদ্ধ জনতার বিভিন্ন কথা আজগর সাহেবদের কানে ভেসে আসতে লাগলো। কেউ কেউ বলছে,’সত্যের জয় হয়েছে।’ আবার কেউ কেউ বলছে,’টাকার কাছে আজ আইন নত হয় নি।’ সমস্ত ভিড় উপেক্ষা করে আজগর সাহেব তাঁর দামী গাড়িটায় উঠে সেখান থেকে চলে গেলেন।
ঘড়িতে সময় রাত ১:৪৭। আজগর সাহেবের চোখে ঘুম নেই। আজ যা হয়ে গেলো তাতে চোখে ঘুম না আসাটাই স্বাভাবিক। তিনি বরাবরের মত তাঁর ইজি চেয়ারটায় বসে আছেন। তবে অন্যদিন চেয়ারে বসে থাকলে তিনি চেয়ারটি সমান্য দুলান কিন্তু আজ তিনি তেমন কিছুই করছেন না। মূর্তির মত চেয়ারটায় পড়ে রইলেন। আজ যে জীবন তাকে ভাবীয়ে তুলেছে। জীবন তাকে তাঁর সেই পুরুনো স্মৃতিগুলো মনে করিয়ে দিচ্ছে । যেভাবে তিনি বড় হয়েছেন! যেভাবে তিনি অসহায় মানুষের লাখ লাখ টাকা আত্মসাদ করে তাদের পথে বসিয়েছেন। বিশেষ করে তাঁর পার্টনার আব্দুল মজিদ সাহেবকে খুব মনে পড়ছে। আহ্, কতই না ভালো একটা মানুষ ছিলেন। কতই না বিশ্বাস করতেন তাকে। কিন্তু তিনি! সেই বিশ্বাসের প্রতিদান খুব ভালোভাবেই দিয়েছেন। তার গুছিয়ে রাখা ব্যবসাগুলো হাতিয়ে নেওয়ার জন্য তাকেই খুন করলেন। বসেছিলেন এক অবৈধ সম্পত্তির রাজ্যের আসনে। এই অবৈধ সম্পত্তি তাকে সুখ দিয়েছিলো ক্ষণিকের জন্য। কিন্তু সময়ের প্রত্যাবর্তনে আজগর সাহেব যে আজ বড়ই একা। এই পৃথিবীতে আপন বলতে তাঁর আর কেউই রইলো না। শেষ সম্বল ছেলেটাকেও তিনি হারালেন। আজগর সাহেব সময়কে ব্যবহার করিছিলেন তাঁর নিজের প্রয়োজনে কিন্তু আজ সময় ঠিকই তার পূর্ণ প্রতিশোধ নিলো।
পরিক্ষা-নিরিক্ষা — পরীক্ষা-নিরীক্ষা
রুগি — রোগী
হয় নি — হয়নি (নি শব্দের সাথে যুক্ত হয়)
পাপের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ কখনো প্রকৃত সুখ দিতে পারে না। সে সুখ ক্ষণিকের হয়। পাপ মানুষকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়।
গল্পের মাঝে সুন্দর একটা মুলভাব খুঁজে পেলাম।