তাহসিন আহমেদ
“ফারুক, আমার মনে অয় ওরে আসপাতালে নিলেই ভালো অইবো।”
ফারুক মাথা দোলায়। সে বুঝতে পারছে না, ঠিক এই মুহূর্তে কী করতে হবে? কারেন্ট নেই অনেকক্ষণ ধরে। ঘরের মধ্যে ভ্যাপসা গরমের প্রভাব লক্ষণীয়। গরমটা বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে না তবে ভেতরে ভেতরে বেশ গরম। করিমুন বিবিকে সে আস্তে করে বলে, “খালাম্মা, কষ্ট কইরা চালায় দেন।”
করিমুন বিবি ঘুরে দাঁড়ায়। তার মনে হয় না এইবার আর মেয়েটাকে বাঁচাতে পারবে। তিনি একটু আগে দেখে এসেছেন প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। নিজের অজান্তেই বড় একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে পরলো।
রহিমা শক্ত করে বিছানার চাদর ধরে আছে। টেবিলের ওপরে রাখা চার্জার লাইটটি তার দিকে মুখ করা। বিন্দু বিন্দু ঘাম তার সারা মুখ দখল করে আছে। মনে হচ্ছে অনেকগুলো রুপার বিন্দু বসিয়ে দেওয়া হয়েছে তার মুখে। নগ্ন চার্জার লাইটের আলোর পরিমাণ খুব বেশি না। তারপরও স্পষ্ট করে সে আজরাইলকে দেখতে পাচ্ছে। তার মাথার ডানপাশে দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করছে সঠিক সময়ের।
করিমুন বিবির খসে পরা চামড়ার মুখ দেখতে পেল রহিমা। ওর দিকে কিছুটা নামিয়ে এনেছেন। ঘোৎ করে একটা শব্দ করলেন বৃদ্ধা, পরক্ষণেই সরে গেলেন রহিমার মুখের সামনে থেকে। যেন, বহুকাল অপেক্ষা করা কোনো দৈত্য চেরাগ থেকে ফস পরে বেরিয়ে গেল। করিমুন বিবি বললেন, “জোরে চাপ দে মাগী। মইরাই তো যাবি, তড়াতড়ি মর”।
বুড়ি ঠিক কথাই বলেছে। মৃত্যুযন্ত্রণা যত কম সময়ে শেষ হয় তত ভালো। বিছানাটা আরো জোরে আঁকড়ে ধরলো রহিমা। তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই বেঁচে থাকার। জোরে চাপ দিলো একবার, দুইবার, তিনবার। কিছু একটার ভারমুক্ত হয়ে গেলো। হয়তো নতুন কোনো অস্তিত্বের। এটা এক অন্যরকম ভালোলাগা, এই নিয়ে পঞ্চমবারের মতো অভিজ্ঞতাটা হলো।
“বাঁচছোস এইবারের লেইগা, সামনের বার আজরাইল তোরে ছাড় দিবো না মাগী।”
বুড়ির মুখটা দেখতে পেল না রহিমা। তবে শব্দটা শুনতে পেল ভালোভাবেই। এরপর আর কিছুই মনে নেই তার।
ফারুকের পাশে এসে দাঁড়ালো করিমুন বিবি। অনাগ্রহের সাথে বললো, “বাঁচাইছে আল্লায় তয় মাইয়া।”
ফারুক কিছু বললো না। ওজুর বদনা নিয়ে ওজু করতে বসে গেল। তার খুব মন খারাপ। টুপি খুঁজতে গিয়ে দেখে চারটা মেয়ে জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে আছে। নিষ্পাপ মুখগুলো দেখে ফারুকের মন খারাপের পরিমাণ আরো বেড়ে গেলো। চুপচাপ বের হয়ে গেল ঘর থেকে। তাকে আযান দিতে হবে তবে খুব সাবধানে। কেউ যেন শুনতে না পায়।
রাত প্রায় আড়াইটা বাজে। বড় রাস্তার পাশ দিয়ে একটি রিকশা খুব দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় আর কোন গাড়ি নেই।
“ওয়াও ওয়াও” স্বরে নাঁকি কান্না কাঁদছে এক শিশু। রিকশাচালক ফারুক এক হাতে তার সদ্যপ্রসূত মেয়েটিকে নিয়ে অন্যহাতে রিকশা নিয়ন্ত্রণ করছে। দুটো কাজ একসাথে করতে ভালোই বেগ পেতে হচ্ছে তাকে।
জায়গামতো এসে পৌঁছলো ফারুক। এখানে রাস্তার পাশে একটা টিলা আছে। সাদা কাপড়ে পেঁচানো বস্তুটি লোকচক্ষুর অন্তরালে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। টিলার ওপরে মেয়েকে রেখে কপালে একবার চুমু খেলো সে। মধ্যবয়সী এক লোক তার অপ্রত্যাশিত মেয়েকে সামনে রেখে হু হু করে কাঁদছে অথচ এই দৃশ্যটি পৃথিবীর কেউ দেখতে পারছে না।
উঠে ঘুরে দাঁড়ালো ফারুক। মেয়েটার চিৎকারের পরিমাণ আরো বেড়ে গেছে। রাতে শব্দের তীব্রতা দিনের তুলনায় অনেক বেশি। ফারুকের মনে হচ্ছে, কেউ তাকে বাবা বাবা বলে ডাকছে। ইচ্ছে করছে, মেয়েকে নিয়ে দৌঁড়ে চলে যায়। কিন্তু কিছু একটা তাকে এই কাজটি করতে দিচ্ছে না৷ খুব সম্ভবত গভীর এক জড়তা।
মেয়েটা কাঁদছে, ফারুক চলে যাচ্ছে। একবার ঘুরে তাকানোর প্রবল ইচ্ছে থাকলেও ফারুকের তা করলো না। কিছুক্ষণ পর দ্রুতবেগে রিকশাটিকে ফিরে আসতে দেখা গেল। এবারো রাস্তায় আর কোন গাড়ি নেই।
সকালে একটু দূরে আড়ালে দাঁড়িয়ে মেয়েকে আরেকবার দেখে নিলো ফারুক। নাক, চোখ রহিমার মতো হলেও কান আর ঠোঁটটা একদম তার মতোই হয়েছে। ঢাকা থেকে এক নিঃসন্তান দম্পতি এসে অনেকটা নিরবেই নিয়ে গেল মেয়েটিকে। প্রাইভেটকারটি চলে যাওয়ার সময় সেদিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো ফারুক। মনে হলো, কেউ আস্তে আস্তে তার হৃদপিন্ডের একটি অংশ টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
তবে ফারুকের ভালো লাগছে। অস্তিত্ব একবেলা খেয়ে বেঁচে থাকার চাইতে তিনবেলা পেট পুরে খেতে পারলেই তো তার শান্তি। এই অস্তিত্বের পিছুটান উপেক্ষা করাই শ্রেয়।
পরিশিষ্ট-
রহিমার জ্ঞান ফিরেছে। দুইদিন অজ্ঞান থাকায় চোখের নিচে কালি পরে গেছে তার। জ্ঞান ফেরার পর থেকেই সে বাবু বাবু বলে কাঁদছিলো। ফারুক নিঃশব্দে রহিমার পাশে এসে বসলো। সবরি কলার ছড়াটা এগিয়ে দিতে দিতে বললো-
“চোখের সামনেই কবর দিছি মাইয়াডারে। ইচ্ছা করলেই দেখতে পারবা। কুনু সমস্যা তো নাই। হেরপরও এতো কান্দন লাগে? নেও কলা খাও।”
গত বারো বছর ধরে রহিমা একটা কলাগাছের কবর জেয়ারত করছে। এই তথ্য তার কাছে অজানাই থাকুক। কিছু রহস্য, রহস্যের ফাঁদে আটকে পরা মানুষদের কাছে না বলাই ভালো। এই রহস্যটাও ঠিক তেমনি।
(সমাপ্ত)
অসাধারণ। পুরো গল্পটি পড়ে আমি বাকরুদ্ধ। লেখার ধাঁচ খুবই সুন্দর। মনের গহীনে নাড়া দেয়ার মত একটি গল্প।
খুবই ভালো লিখেছেন। অনেক শুভ কামনা ও ধন্যবাদ রইল এতো সুন্দর একটি গল্প উপহার দেয়ার জন্য।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ @আফরোজা আক্তার ইতি
হৃদয়ে নাড়া দিলো গল্পটা।
ভিন্ন ধরনের এই গল্পের উপস্থাপনভঙ্গি দারুণ ভালো লেগেছে।
সত্যি অভাবের তাড়নে মানুষ কি না করতে পারে?
নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতেও বেগ পেতে হয়না।
ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল মানুষ,বিধাতা সবাইকে ভালো রাখুক – এই দোয়া করি।
লেখকের জন্য শুভকামনা রইলো।