দুনিয়ার শাস্তি
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৮
লেখকঃ augustmault0163

 1,645 বার দেখা হয়েছে

এই লেখক এর আরও লেখা পড়ুনঃ augustmault0163

রেহেনা বিনতে আজিজ
.
বিশাল বড় উঠান। উঠানে অনেক ভিড়। তবুও সুনসান নীরবতা। উঠানের একপাশে দাঁড়িয়ে নীরবে কেঁদে যাচ্ছে শফিকের স্ত্রী সামিয়া।
গ্রামের মহিলারা সামিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে আর মনে মনে বলছে, ‘এত ভালো একটা মেয়ে এমন কাজ করতে পারল।’
গ্রামের মাতব্বর এসে গেছেন। ‘আসেন সাহেব, আসেন। এখানে বসুন।’ চেয়ার টানতে টানতে বলল শফিক। মাতব্বর সাহেব চেয়রে বসে বললেন, ‘এমন একটা ভালো মাইয়্যা এমন কাম করতে পারল! ‘
শফিক বলে, ‘ভালো মাইয়্যা, উুহু, চরিত্রে দোষ আছে ওর। ঘরে স্বামী রেখে পরপুরুষের সাথে থাকবে।’
সামিয়ার কান্না আরো বেড়ে যায়। স্বামীর পায়ে ধরে বলে, ‘আপনি আমাকে যা ইচ্ছা শাস্তি দিন কিন্তু এমন বড় মিথ্যা অপবাদ আমাকে দিবেন না।’ওঠে দাঁড়িয়ে মাতব্বরকে সামিয়া বলল, ‘আপনি উনার কথা বিশ্বাস করবেন না। আমি নির্দোষ। আল্লাহ সব জানেন। আমি কোন ব্যাভিচারে লিপ্ত হইনি।
‘আমি কার কথা বিশ্বাস করব। তুমি বলছো তুমি নিররদোষ আর শফিক বলছে ও তোমাকে দেখেছে পরপুরুষের সাথে থাকতে।’ মুখে একগাল পান পুরে বললেন মাতব্বর।
.
গ্রমের মহিলারা সামিয়াকে নিয়ে অনেক বাজে মন্তব্য করছে।ছিঃ ছিঃ এমন কাজ করতে পারল।মেয়েটাকে দেখা যায় নম্র আসলে ভিতরে তো শয়তানের কারখানা।আমাদেরকে অনেক উপদেশ দিত কিন্তু এখন নিজেই…..।
.
সামিয়া শুধু কাঁদে। মনে মনে বলতে থাকে ্ ‘হে আল্লাহ! তুমি তো সবই জানে। আমাকে সাহায্য কর।’
মাতব্ব্র সাহেব উঠে দাড়ালেন আর বললেন, ‘কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী যারা নিজ স্ত্রীদেরকে ব্যভিচারের অপবাদ দিলো অথচ তাদের সপক্ষে সে ব্যতীত অন্য কোন সাক্ষী নেই তা হলে তাদের প্রত্যেককে চার চার বার এ বলে সাক্ষ্য দিতে হবে যে, সে নিশ্চয়ই সত্যবাদী। পঞ্চমবার সে এ কথা বলবে যে, তার উপর আল্লাহ্ তা‘আলার লা’নত পতিত হোক সে যদি এ ব্যাপারে মিথ্যাবাদী হয়ে থাকে। তবে স্ত্রীর শাস্তি রহিত হবে সে এ ব্যাপারে চার চার বার সাক্ষ্য দিলে যে, তার স্বামী নিশ্চয়ই মিথ্যাবাদী। পঞ্চমবার সে এ কথা বলবে যে, তার উপর আল্লাহ্ তা‘আলার গযব পতিত হোক যদি তার স্বামী এ ব্যাপারে সত্যবাদী হয়ে থাকে’’।
সুতরাং তোমাদেরকে তাই করতে হবে। শফিক চার বার সাক্ষ্য দিল আর সামিয়াও বলল, তার স্বামী মিথ্যা বলছে।
.
শফিকের মুখে শয়তানি হাসি ফুটে উঠেছে। সামিয়াকে অপবাদ দিয়ে গ্রাম ছাড়া করা হয়। সামিয়া দুঃখের বোঝা মাথায় নিয়ে মায়ের বাড়িতে চলে আসে। বাবা মারা গেছে চার বছর হলো। এখানে আছে শুধু তার মা আর ছোট্ট ভাই সামিন। নবম শ্রেণীতে পড়ে।
.
প্রায় তিন বছর আগে পারিবারিক ভাবেই শফিক আর সামিয়ার বিয়ে হয়। খুব সুন্দরভাবে চলত তাদের সংসার। সারাদিন খুনসুটি আর ভালোবাসা। তাদের এই জুটি দেখে অনেকের হিংসে হত। দেখে বুঝা যেত না যে এটা তাদের পারিবারিক বিয়ে।
দু’বছর কেটে গেল কিন্তু তাদের কোলে সন্তান আসেনি। সামিয়াকে অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি। সামিয়া মন খারাপ করে থাকত। শরিফ বলত, ‘ সব ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া আমরা তো এমনিতে অনেক ভালো আছি। তুমি শুধু শুধু মন খারাপ কর নাতো।’
সামিয়া একটু ভরসা পায়।মুখে ফুটে ওঠে হাসির রেখা।
বিয়ের তিন বছরের মাথায় শফিকের মধ্যে পরিবর্তন দেখতে পায় সামিয়া। আগে যেমন তার যত্ন নিত এখন নেয় না। ফুল, চকলেট কত কিছুই না এনে দিত কিন্তু হঠাৎ এখন কী হলো? সামিয়া কিছু বলতে গেলেই শফিক অনেক উচ্চস্বরে কথা বলে। ধমক দেয়।
সামিয়া কিছু বুঝতে পারে না। একদিন সে বলল, ‘আপনার কী হয়েছে? আগে তো এমন ব্যবহার করতেন না। হঠাৎ করে এমন পরিবর্তন কেন?’
চোখ দু’টো লাল করে সামিয়ার দিকে তাকায় শফিক। বিছানা থেকে ওঠে বলল, ‘সেটা তোমাকে বলে কী লাভ? আমার একটা সন্তানের প্রয়োজন বুঝলে।কবে আমি বাবা ডাক শুনতে পারব?
অজান্তেই সামিয়ার চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। শফিকের কাধে হাত দিলে বলে, ‘এ কথা আপনি বলতে পারলেন। আমি কি করব। সবই তো আল্লাহর ইচ্ছা। মা ডাক শুনতে পারছি না, এজন্য কি আমার দুঃখ কম।’
‘যাই বল।আমি আর তোমার সাথে থাকতে পারব না। ‘
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে সামিয়ার। এই কি সেই শফিক। ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ে সে।
‘আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাব না।’
‘যাবে না? কী করে যাওয়াতে হয় সেটা আমি ভালো করে জানি।” বলেই শফিক রুম থেকে চলে যায়। সামিয়ার মাথায় শফিকের কথাগুলোই ঘূর্ণপাক খাচ্ছে।চিন্তা করতে করতে সে এক সময় ঘুমের দেশে চলে যায়।
.
কর্কষ আওয়াজে ঘুম ভাঙল তার। তাকিয়ে দেখল শফিক দাঁড়িয়ে আছে।
‘মহা রাণীর ঘুম ভাঙল তাহলে। বাইরে চল। একটু পর মাতব্বর এসে পড়বেন।সামিয়া কিছু বুঝার আগেই তাকে টেনে হিচড়ে উঠানে বের করে।
.
.
.
সামিয়াকে এই অবস্থায় হঠাৎ দেখে তার মা ও ভাই অবাক হয়। সামিন দৌড়ে আসে তার আপুর কাছে।
‘আপু, তুমি হঠাৎ এই সময়? কী হয়েছে? তোমার চোখে পানি কেন?’
‘সব বলব রে।’ সামিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে।তারপর মাকে সালাম করে রুমে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই করছে। কালো আঁধারে ঢেকে যাচ্ছে চারপাশ। পাখিরা ফিরছে আপন নীঁড়ে। একটু পরেই মাগরিবের আযান হবে। বিছানা থেকে ওঠে অজু করে জায়নামাজে বসে পড়ল সামিয়া। নিভৃতে শুধু জ্বল ফেলছে আর তা গড়িয়ে পড়ছে জায়নামাজের ওপর।
আযান হয়ে গেছে। নামাজ পড়ে দু’হাত তুলল আল্লাহর দরবারে। “হে আল্লাহ! হে দয়াময় রাহমানুর রাহীম। জানিনা কোন পরীক্ষা নিচ্ছ।জানিনা আমার স্বামী কেন এমন করলেন। হে আল্লাহ! তুমি উনাকে বুঝার তাওফীক দিও। যে অপবাদ সবাই আমাকে দিচ্ছে তা যে মিথ্যা এটা একদিন সবার সামনে প্রমাণ করে দিও। আমিন।”
নামাজ শেষে সামিয়ার মা সামিয়ার পাশে এসে বসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে রে মা?’
মায়ের কাঁধে মাথা রাখলো সামিয়া। সবকিছু খুলে বলল। সবকিছু শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন মা। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সামিনের চোখেও পানি চলে আসলো।
‘আপুরে, তোমকে যে এতবড় অপবাদ আর শাস্তি দিল তার একদিন বিচার হবে। এই পৃথিবীতে থাকা অবস্থায় তার বিচার হবে।’
মা তখন বলেন, ‘সামিন ঠিক বলেছে। জানিস সামিয়া, ইসলামে নারীর মর্যাদা অন্য যে কোনো ধর্মের চেয়ে বেশি। বিশেষ করে জননীর জাতি নারীর প্রতি অপবাদের যে কোনো প্রবণতার বিরুদ্ধে ইসলাম কঠোর অবস্থান ঘোষণা করেছে। কেউ যাতে তাদের বিরুদ্ধে অপবাদ রটনায় সাহসী না হয় সে বিষয়ে সতর্ক করতে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহপাক ঘোষণা করেন : ‘যারা সতী-সাধ্বী, নিরীহ মুমিন নারীদের বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপ করে, তারা ইহলোক ও পরলোকে অভিশপ্ত এবং তাদের জন্য রয়েছে গুরুতর শাস্তি।’
চোখের পানি মুছে সামিয়া বলল, ‘হ্যা মা, আমি জানি। আল্লাহ আমাকে বিপদে ফেলে পরীক্ষা করছেন। যেভাবে পরীক্ষা করেছেন হযরত আয়শা (রাঃ) কে।
.
দশদিন পর খবর জানা যায় শফিক বিয়ে করেছে।সুন্দরী একজন মেয়েকে ধুমধাম করে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে। সামিন তার আপুকে বলে, ‘আমি যা ভাবছিলাম তাই হয়েছে।কেন তোমাকে অপবাদ দিয়ে ঘর ছাড়া করেছে।’
‘কেন?’
‘সুন্দরী মেয়ে দেখে উনি পাগল হয়ে যান।তারপর তোমাকে বের করার একটা রাস্তা বের করেন। অপবাদ দিয়ে এজন্য বের করে দিয়ে যাতে তুমি এই মুখ নিয়ে ওর সামনে যেতে না পারো আর যৌতুকে হিসেবে যে তিন লক্ষ টাকা নিয়ে ছিল ঐ টাকারও দাবি করতে না পারো।আপু, তুমি মন খারাপ করে থেকো না দেখবে একদিন ঐ লোকটার কঠিন শাস্তি হবে। সকলের সামনে অপবাদ দিয়েছিল তেমনি তুমি যে নির্দোষ সেটা সকলের সামনেই বলবে।’
সামিনের কথাগুলো শুনেই যাচ্ছে সামিয়া। পাশের রুমে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াল। যাবার সময় বলল, ‘তাই যেন হয়।’
তখনি মা এসে দাড়ালেন আর সামিয়াকে বললেন, ‘সামিয়া, একটা কথা বলব যদি তুই অনুমুতি দিস তাহলে…’
‘বল মা কী বলতে চাও’
‘বলছিলাম যে তোর যদি আপত্তি না থাকে তাহলে তোর আরেকটি বিয়ের কথা পাকা করব।’
সামিয়া ভেবে পায় না কি উত্তর দেবে। একটু পর বলল, ‘না মা এ হয় না।মেয়েদের জীবনে বিয়ে একবারই হয়। আর বিয়ে করে আমি একবার ঠকেছি আর নয়।’
‘তোর ধারণাটা ভুল মা। ভালো মন্দ নিয়েই মানুষের জীবন। প্রথম বিয়েটা ছিল আমাদের ভুলে। আমরা শফিকের সম্পর্কে ভালো করে না জেনে শুনে হঠাৎ করেই তোকে বিয়ে দিয়ে দিলাম। এবার আর তা হবে না।’
‘কিন্তু মা, আমার এই অপবাদের কথা শুনে কেউ কি রাজি হবে!’
‘মা রে, হাতের পাঁচ আঙুল যেমন সমান নয় তেমনি পৃথিবীর সকল মানুষ সমান নয়। পৃথিবীর অনেক মানুষ আছে যারা মানুষকে চিনতে ভুল করে না।তুই আবদুল্লাহ কে চিনিস?’
‘হ্যা জানি তো। ঐ যে নানু বাড়ির মসজিদের ইমামতি করেন উনি না?’
‘হ্যা ‘
‘ও সব জেনে শুনে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। ওতো তোকে ভালো করে জানে।।তুই যে এ কাজ করিস নি তা আমরা যেমন বিশ্বাস করি তেমনি আবদুল্লাহও বিশ্বাস করে।’
পেছন থেকে সামিন বলল, ‘হ্যা আপু, আমি উনাকে সব বলেছিলাম।’
সামিয়া কিছু বলল না। পাশের রোমে চলে যায়।
.
চারমাস পর সামিয়া আর আবদুল্লাহর সাদামাটা ভাবেই বিয়ে হয়। সুন্দরভাবে তাদের নতুন জীবন কাটতে লাগল। আবদুল্লাহ প্রতিদিন বাজার থেকে আসার সময় সামিয়ার জন্য ইসলামিক বই নিয়ে আসে। সুন্দর করে এই উপহারটা সামিয়ার হাতে তুলে দেয়। সামিয়া মুচকি হেসে বইটা হাত থেকে নিয়ে বলে, ‘তোমাকে পেয়ে আমি ধন্য। দুনিয়ার বাকি জীবনে আর পরকালেও যেন আমি তোমাকে পাই।’
সামিয়ার হাতটা ধরে আবদুল্লাহ বলে, ‘আমি সেটা প্রতিদিন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলি।’
আব্দুল্লাহর বুকে বুক লুকিয়ে নেয় সামিয়া।
.
আর ঐদিকে শফিকের জীবন দুর্বিষহ হয়ে কাটতে লাগল। সামিয়াকে অপবাদ দিয়ে বের করার পর ত্রয়ীকে বিয়ে করেছিল। এখন সেই ত্রয়ী তার জীবনের কালো অধ্যায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন তাদের মধ্যে ঝগড়া, বিবাদ লেগেই আছে। একদিন শফিক বলেই দিল, ‘তোমার চেয়ে সামিয়াই ভালো ছিল। কেন যে আমি তোমার প্রেমে পড়েছিলাম! এই তোমার জন্যই আমি সামিয়াকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ঘর ছাড়া করি।’
রাগান্বিত সুরে ত্রয়ী বলে, ‘তো কী হয়েছে? আমি কি বলেছিলাম আমাকে বিয়ে কর? আমি তোমার সম্পদ দেখে রাজি হয়ে ছিলাম। কিন্তু এখন জানতে পারলাম তিন ভাগের দুই ভাগই তোমার চাচার। এই জন্যই তুমি সামিয়াদের কাছ থেকে যৌতুক এনেছিলে তাইনা? আর আরেকটা কথা শুনে রাখো কোন সতী নারীকে অপবাদ দিলে তার জীবন কখনও সুখের হয় না। তুমি না দুনিয়াতে শান্তিতে থাকবে না আখেরাতে। আমি চললাম। তোমার সাথে আমার আর থাকা সম্ভব না। ভালো একটা মেয়েকে অপবাদ দিতে তোমার সময় লাগেনি আর আমাকে অপবাদ দিতে তোমার কতক্ষণ।’
‘ত্রয়ী, ত্রয়ী। আমার কথা শুনো ত্রয়ী।’ ত্রয়ীর পেছন পেছন যেতে যেতেই বলছে শফিক।ত্রয়ীকে আর থামাতে পারেনি।নিজের কপাল চাপড়াতে থাকে সে।
.
দুর্বিষময় আর একাকীত্বে জীবন কাটতে লাগল। খোঁজ নিয়ে জানতে পারে সামিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে।
অসুস্থ হয়ে পড়ে শফিক। সারা শরীর পচনে ধরেছে। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে থাকে সে। একাকীত্তে থাকতে থাকতে বুঝতে পারল সে আর কথা বলতে পারে না। মনে মনে বলে, “আমার মুখ দিয়ে কথা বেরুবে কিভাবে, যে মুখ দিয়ে আমি সামিয়াকে অপবাদ দিয়েছিলাম সেই মুখ দিয়ে কথা তো কথা না বের হবার কথা। সামিয়ার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।”
চট করে হাতে কলম খাতা তুলে নিল। চিঠি লিখল সামিয়ার কাছে।
.
যোহরের নামাজ পড়ে সামিয়া বিছানায় শুয়েছিল। আবদুল্লাহও মসজিদ থেকে ফিরেছে। সামিয়ার হাতে একটা কাগজ দিয়ে বলল, ‘এই নাও সামিয়া। মসজিদ থেকে আসার সময় একটা ছোট্ট ছেলে আমার হাতে দিয়ে বলল এটা তোমাকে দেয়ার জন্য। আমি পড়িনি, তুমি পড়ে দেখ।’
কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজটা হাতে নিল সামিয়া আর মনে মনে ভাবছে না জানি আর কোন অপবাদ তার জন্য অপেক্ষা করছে। কাগজের ভাজ খুলে পড়তে লাগল সে।
প্রিয় সামিয়া,
জানি ভালো আছো। কিন্তু আমি ভালো নেই। আমি যে অন্যায় কাজ করেছি তার জন্য কি ভালো থাকতে পারি। তোমাকে অপবাদ দিয়ে ত্রয়ীকে বিয়ে করে ছিলাম। সেই ত্রয়ী আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। যে মুখ দিয়ে আমি তোমাকে অপবাদ দিয়েছিলাম সেই মুখ আমার বন্ধ হয়ে গেছে। আমি বোবা হয়ে গেছি সামিয়া তুমি আমায় ক্ষমা করো। তুমি যদি মাফ না কর তাহলে আল্লাহ আমাকে মাফ করবেন না।আমার সারা শরীরে পচন ধরেছে। সামিয়া, আমি তোমাকে সকলের সামনে যেভাবে অপবাদ দিয়েছিলাম সেভাবেই সকলের সামনে বলব তুমি নির্দোষ। তুমি দয়া করে তোমার স্বামীকে নিয়ে কালকে আমাদের বাড়িতে চলে আসবে। শুধু তোমার ক্ষমার অপেক্ষার থাকলাম।
ইতি
শফিক
.
দু’চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে সামিয়ার। সামিয়ার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে আবুল্লাহ বলে, ‘দেখলে সামিয়া, পাপ করলে দুনিয়াতে কীভাবে শাস্তি হয়। শফিক তার শাস্তি পাচ্ছে। কালকে তোমাকে নিয়ে যাব। তুমি ওকে মাফ করে দিও।’
.
ঠিক এক বছর আগের মত সেই উঠানে অনেক ভীড়। সেই মাতব্বরও এসেছেন। আল্লাহর কী কুদরত। সামিয়া মাফ করে দেয়ার সাথে সাথে শফিকের জবান খুলে যায়। তারপর সকলের সামনে দাড়িয়ে শফিক বলল, “ঠিক এক বছর আগে এমনি দিনে আমি সামিয়াকে অপবাদ দিয়ে ঘর ছাড়া করেছিলাম। অন্য একজন মেয়ের রূপে মুগ্ধ হয়ে নিজের গুণবতী স্ত্রীকে অপবাদ দিয়ে, অপমান করে বাহির করে দিয়েছিলাম। যার শাস্তি আমি পেয়েছি যা আপনারা দেখতে পাচ্ছেন। আমি আর বেশি দিন নাও বাচতে পারি। সকলের নিকট আমার অনুরোধ আপনারা আপনাদের স্ত্রীকে ভালবাসুন, তার সাথে সুন্দর ব্যবহার করুন।ভুলেও সতী নারীর চরিত্রে কলনক ধরাবেন না। নইলে আপনার জীবনটা ধ্বংস হয়ে যাবে। যার জ্বলন্ত প্রমাণ আমি।’
শফিক কথাগুলো বলে থামল। দেখল সকলের চোখে পানি। আবদুল্লাহ শফিকের কাধে হাত দিয়ে বলে, ‘আপনার কথাগুলো সকলের জন্যই একটি শিক্ষা। সবারই মনে থাকবে। আর কেউ অপবাদ দেয়ার আগে অন্তত আপনার কথা মনে পড়বে।’
আব্দুল্লাহর হাতটা ধরে শফিক বলে, ‘আমি যে ভুল সামিয়ার সাথে করেছি তা ভুলেও তুমি করো না ভাই।ওকে তুমি সুখে রেখো।’
‘জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ওর সাথে থাকব।’ শফিকের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল আবদুল্লাহ। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সামিয়া তাদের কথা শুনছিল। গ্রামের কয়েকজন মহিলা এসে দাঁড়ালেন সামিয়ার পাশে।
‘সামিয়া, তুমি আমদেরকে ক্ষমা করে দিও।শফিকের কথা বিশ্বাস করে তোমাকে অনেক গালি দিয়েছি।’
‘হ্যা সামিয়া, তুমি যদি ক্ষমা না কর তাহলে আমদের পাপের বোঝা হালকা হবে না।’
মুচকি হেসে সামিয়া বলে, ‘আমি ক্ষমা করে দিলাম। একটি কথা সব সময় মনে রাখবা যে, কাউকে কোন কিছু বলার আগে তা সত্য মিথ্যা যাচাই করে নেয়া ভালো, তা না হলে পরে শুধু আফসোস করা ছাড়া কোন কিছুই মিলবে না।’
সবাই একসাথে বলে ওঠল, ‘আমাদের মনে থাকবে সামিয়া।’
.
আব্দুল্লাহ আর সামিয়ার জীবন সুন্দর ভাবেই কাটতে থাকে। তাদের সংসারে নতুন অতিথি হয়ে আসে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান। আব্দুল্লাহ তার মেয়ের নাম সামিয়ার নামের সাথে মিল রেখে রাখল সুমাইয়্যা বিনতে আব্দুল্লাহ।
.
শফিক এখনো বেঁচে আছে তার পচন শরীর নিয়ে। হয়ত এভাবেই দুনিয়ার শাস্তি নিয়ে দৃষ্টান্ত হিসেবে বেঁচে থাকবে অনেক দিন।
(সমাপ্ত)

সম্পর্কিত পোস্ট

পূনর্জন্ম

জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি . কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু...

অনুভূতি

অনুভূতি

লেখা: মুন্নি রহমান চারদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লো মালা। ঘরের কাজ সেরে বের হতে হবে ফুল কিনতে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না আর ফুল তরতাজা না হলে কেউ কিনতে চায় না। মাথার ওপরে তপ্ত রোদ যেন...

অসাধারণ বাবা

অসাধারণ বাবা

লেখক:সাজেদ আল শাফি বাসায় আসলাম প্রায় চার মাস পর। বাবা অসুস্থ খুব।তা নাহলে হয়তো আরও পরে আসতে হতো।গাড়ি ভাড়া লাগে ছয়শো পঁচিশ টাকা।এই টাকাটা রুমমেটের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।তার কাছে এই পর্যন্ত দশ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে।বলি চাকরি হলেই দিয়ে দিব। পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর...

১ Comment

  1. আফরোজা আক্তার ইতি

    অত্যন্ত সুন্দর শিক্ষামূলক একটি গল্প লিখেছেন। এমন সুন্দর একটি গল্প আমাদের উপহার দেয়ার জন্য লেখিকাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। সামিয়ার মত কত মেয়ে যে আমাদের সমাজে এমন মিথ্যা অপবাদের শিকার হচ্ছে তার কোন হিসেব নেই, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে হাজারো মেয়ের সুন্দর জীবন।
    কিন্তু শফিক তার পাপকর্মের শাস্তি ঠিকই পেয়েছে। সে তার অপরাধ ঠিকই বুঝতে পেরেছে। কিন্তু ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে।
    অবশেষে সামিয়া ফিরে পেল তার যোগ্য সম্মান এবং সুখের সন্ধান। একজন নেক স্বামী ও একটি ফুটফুটে কন্যা।
    ভালো গল্প। কিন্তু লেখিকা খুব তাড়াহুড়ো করে লিখেছেন যার জন্য অনেক টাইপিং মিস্টেক আছে।
    চেয়রে- চেয়ারে।
    নিররদোষ- নির্দোষ।
    দাড়ালেন- দাঁড়ালেন।
    কাধে- কাঁধে।
    হিচড়ে- হিঁচড়ে।
    নীঁড়ে- নীড়ে।
    জ্বল- জল।
    হ্যা- হ্যাঁ।
    রোমে- রুমে।
    ভাজ- ভাঁজ।
    আবুল্লাহ- আব্দুল্লাহ।
    বাচতে- বাঁচতে।
    কলনক- কলঙ্ক।

    Reply

Submit a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *