জুয়াইরিয়া জেসমিন অর্পি
.
কলেজ থেকে ফিরেই পিঠের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেললো অন্বেষা। তারপর পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ ওর। আজ ওদের সেমিস্টার ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। একদমই ভালো করেনি সে। যদিও শুরু থেকেই এবার ওর প্রিপারেশন অতটা ভালো ছিলো না। তাই বলে এতটা খারাপ হবে ভাবেনি। একদম যাচ্ছেতাই অবস্থা!
অনুপ্রভা এক গ্লাস পানি হাতে মেয়ের ঘরে ঢুকলেন।
“কিরে এষা এভাবে বসে আছিস কেনো? জামা-কাপড় বদলে নে।”
অন্বেষা কোন উত্তর করলো না। আগের মতোই থম মেরে বসে রইলো।
অনুপ্রভা পানির গ্লাসটা টেবিলে রেখে বিছানার দিকে এগিয়ে অন্বেষার ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললেন, “আজকে না রেজাল্ট দেয়ার কথা? খাতা দিয়েছে? ব্যাগে আছে নাকি বের করে রেখেছিস? কেমন হলো রেজাল্ট?”
মায়ের এতসব খবরদারি তে ফোঁস করে উঠলো অন্বেষা। চেয়ার থেকে উঠে এসে ব্যাগটা ঝট করে কেড়ে নিয়ে বললো, “তুমি আবার কী বুঝবে আমার পড়াশোনার হ্যাঁ? নিজের কাজ নিয়ে থাকো। আর আমাকেও আমার মতো থাকতে দাও। কতবার বলেছি যে আমার জিনিসে হাত দিবে না। কথা শোনো না কেনো একবার বললে?”
অনুপ্রভা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ অন্বেষার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “আমি তো শুধু তোর ব্যাগটা বিছানা থেকে সরিয়ে রাখছিলাম। ভেতরে তো আর হাত দেইনি।”
“উফফ মা! প্রতিদিন এভাবে ড্রামা না করলে হয় না? যাও তো এখন প্লিজ।”
অনুপ্রভা কিছু না বলে বেরিয়ে এলেন মেয়ের ঘর থেকে।
.
টেবিলে খাবার দিয়ে অনুপ্রভা মেয়েকে আবার ডাকলেন। হাতে ফোন নিয়ে বেরিয়ে এলো অন্বেষা। এসে টেবিলে ওই নরমাল ভাত, ডাল আর সবজি দেখে আবার চেঁচিয়ে উঠলো সে। প্রতিদিন এই সব খাবার খেতে খেতে ক্লান্ত সে। তাই খাবারের প্লেট ঠেলে দিয়ে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। যাওয়ার আগে অবশ্য মাকে শুনিয়ে গেলো যে বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করে নিবে সে।
এবার কখন সেই খাবার আসবে আর কখন মেয়ে খাবে, সেই চিন্তায় মায়েরও যে খাওয়া হবে না সে কথা ভাবার সময় কোথায় তার!
খাবার গুলো আস্তে ধীরে গুছিয়ে রাখলেন অনুপ্রভা। মেয়ের এমন কথা বা আচরণ নতুন নয়। তার জীবনে এটা নিত্যদিনের ঘটনা। আগে টুকটাক জবাব দেয়া বা শাসন করতেন তিনি। কিন্তু মেয়ে যত বড় হচ্ছে ততই যেনো আরো বেড়ে চলেছে তার মায়ের প্রতি অবহেলা।
আগে যার মাকে ছাড়া চলতোই না, এখন সে একা থাকতেই বেশি ভালোবাসে। দিন-রাত শুধু ফোন আর বন্ধুবান্ধব। পড়াশোনার দিকেও মন নেই আর। এছাড়া মায়ের কথা ভাবার দিকটা তো ছেড়েই দিলাম।
অথচ আগে স্কুল থেকে এসেই কোন ম্যাম কি পড়িয়েছেন থেকে শুরু করে কে কি টিফিন এনেছে পর্যন্ত মাকে না বললে তার ঘুম হতো না। আর এখন নিজে কিছু বলা তো দূরের কথা, অনুপ্রভা নিজে কিছু জিজ্ঞেস করলেও অপমানিত হন।
কথায় কথায় শুনতে হয় “তুমি আর কি বুঝবে বাইরের কথা? থাকো তোমার ঘর আর রান্নাঘর নিয়ে।”
স্পেস নিতে নিতে কখন যে এক ঘরে থেকেও প্রতিটা মানুষ একে অপরের থেকে দূরে সরে গেছে তা কল্পনাতীত।
মাঝে মাঝে মনে হয় এই সংসারে তার কোন মূল্য নেই। শুধু রোবটের মতো সব দায়িত্ব গুলো পালন করে চললেই যেন সবার শান্তি। কখনো তো তার মন চায় সব ছেড়েছুড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। কিন্তু চাইলেই কি আর সব ছেড়ে যাওয়া যায়!
সবারই তো নিজের একটি পৃথিবী আছে। এই যেমন অরুণের এই সংসারের বাইরে কাজের সাদাকালো পৃথিবী। অন্বেষার বন্ধুবান্ধব, পড়াশোনা আর হৈ-হুল্লোড়ে ভরা এক রঙিন পৃথিবী। শুধু তারই এই সংসারের বাইরে আর কিছু নেই। অরুণ আর অন্বেষাই তো তার পৃথিবী। কিন্তু মাঝে মাঝে অনুপ্রভার মনে হয় তার নিজের জীবনেও আরেকটা পৃথিবী থাকলে মন্দ হতো না!
.
হাতের কাজ গুলো গুছিয়ে একটু ফেসবুকে ঢুকলেন অনুপ্রভা। এই তো কিছুদিন আগেই অনেক বার বলে বলে মেয়েকে দিয়ে একটা আইডি খুলিয়ে নিয়েছেন। কলেজের বান্ধবী সাথী বললো সবাই নাকি আছে ফেসবুকে। সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো কে আবার একটু ফিরে পাওয়ার চেষ্টা আর কী!
ফেসবুকে বেশিরভাগ সময়ই এর ওর ছবি দেখেই কাটান তিনি। এছাড়া আর কিছু করতে পারেন না। পারবেনই বা কীভাবে! মেয়ের যে একদণ্ড সময় নেই মাকে কিছু শেখানোর।
একদিন বলেছিলেন তিনি অন্বেষাকে একটু শিখিয়ে দিতে এসব ফেসবুক টেসবুক কিভাবে চালায়। মায়ের অজ্ঞতা নিয়ে একচোট হেসে নিয়েছিলো সে। দমে গিয়েছিলেন অনুপ্রভা। তারপর একদিন কী মনে করে যেন একটা আইডি খুলে দিলো সে অনুপ্রভাকে। ব্যস! ওই পর্যন্তই। কীভাবে কী করতে হয় তা শেখানোর আর সময় হয়নি মেয়ের।
.
এই দুপুরের দিকটায় হাতের কাজ শেষে কখনো ফেসবুকে একটু ঢুঁ মারেন বা কোনো গান শোনেন।
আজকেও বসলেন ফোনটা নিয়ে। সবার হাসিখুশি ছবি দেখতে ভালোই লাগে তার।
“আরে! ঐশ্বর্য্যদা না?!”, আপনমনেই বলে উঠলেন অনুপ্রভা। হ্যাঁ! তাই তো!
ফেসবুকে হঠাৎ ঐশ্বর্য্যদার ছবি দেখে বহু বছর আগের কথা মনে পড়ে গেল অনুপ্রভার।
—————
সেই শান্ত সবুজ গ্রাম। গ্রামের মেঠোপথ। দলবেঁধে স্কুলে যাওয়া। পুতুল খেলা আর চড়ুইভাতি। আর গান শেখা। হ্যাঁ গান! গানের কথা মনে হতেই অনুপ্রভার চোখের কোণ চিকচিক করে উঠলো।
তখন অনুপ্রভা শুধু অনু ছিলো। সব বান্ধবীদের সাথে স্কুলে যাওয়া, খেলাধুলো করা এসব করেই দিন কাটতো তার। অনুর পড়ালেখা করতে ভালো লাগতো না একদম। পড়ালেখার চেয়ে যেন গান-বাজনাতেই বেশি আগ্রহ ছিলো তার। বাবা-মায়ের চাপে পড়ে সে কোনরকমে একের পর এক ক্লাস পার করছিলো। ছাত্রী হিসেবেও ছিলো মাঝারী ধরনের।
একদিন খবর পেল গ্রামে নাকি গানের স্কুল হয়েছে। গানের স্কুল? তাও আবার এখানে! মনটা আনন্দে নেচে উঠলো অনুর।
অনেক বায়না করে বাবাকে নিয়ে গেল সেখানে। দেখা গেলো ঠিক স্কুল নয়। গ্রামেরই বরেণকাকার ছেলে ঐশ্বর্য্যদা গান শেখাচ্ছেন কিছু ছেলেমেয়েকে।
অনুও বসে গেল শিখতে। এতোদিনে বুঝি ওর গান শেখার স্বপ্ন পূরণ হবে।
ঐশ্বর্য্যদার গলা ভারি অদ্ভুতরকমের সুন্দর। সে যখন কোন গান গেয়ে শোনাতেন, অনু যেন অন্য এক জগতে ভেসে যেত। ঐশ্বর্য্যদাও লক্ষ্য করতেন অনুকে। নিজের বোনের মতো করেই গান শেখাতেন। সবার মধ্যে থেকেও অনুর গলা যেন এক আলাদা সুর সৃষ্টি করতো।
একদিন হুট করেই ঐশ্বর্য্যদা বললেন, “আর বোধহয় তোদের সাথে গান গাওয়া হবে না রে!”
ঐশ্বর্য্যদার চাকরি হয়ে গিয়েছিলো। চলে গিয়েছিলেন তিনি।
তবে যাওয়ার আগে বার বার বলে গিয়েছিলেন অনুকে, “অনুপ্রভা! ভুলেও গানটা ছাড়িস না। এই গানই একদিন তোর পায়ের নিচের মাটি শক্ত করবে দেখে নিস।”
ঐশ্বর্য্যদা চলে যাওয়ার পর আর সেরকম ভাবে গান না শিখলেও প্রতিদিন রেওয়াজ করতো অনু। গানের প্রতি একটা আলাদা ভালোবাসা ছিলো তার।
কলেজে উঠে যখন গ্রাম ছেড়ে আসা হলো, তখনও এই শহরের ভীড়ে কতবার যে ঐশ্বর্য্যদাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু আর দেখা হয়নি। গান গাইতে যেতো সে যতবার, ততবারই মনে হতো ঐশ্বর্য্যদার কথা।
বিয়ের পর অরুণকেও কতবার গান শুনিয়েছে সে। কিন্তু ওই যে গান নিয়ে বাইরের জগতে পা রাখার স্বপ্নে কখন যে একরাশ ধুলো জমে গেলো, সংসার সামলাতে গিয়ে আর খেয়ালই হলো না অনুপ্রভার।
তারপর অন্বেষা হয়ে গেলো। তখন কোথায় গান আর কোথায় রেওয়াজ। মেয়েকে দেখতেই হিমশিম অবস্থা তার।
—————
আজ এতগুলো বছর পর ঐশ্বর্য্যদাকে দেখে একটা মেসেজ দিয়েই দিলেন অনুপ্রভা।
প্রায় সাথে সাথেই রিপ্লাই এলো।
“ছবি দেখে তো চিনতেই পারিনি রে। বুড়িয়ে গেছিস অনুপ্রভা।”
সবাই অনু নামে ডাকলেও ঐশ্বর্য্যদা সবসময় অনুপ্রভা বলতেন। এতোগুলো দিন পর এতো কাছের একজনকে পেয়ে কথার ঝুড়ি খুলে বসলেন অনুপ্রভা।
এক পর্যায়ে ঐশ্বর্য্যদা বললেন, “গানটা কেনো ছেড়ে দিলি?”
অনুপ্রভা কিছুক্ষণ ভেবে লিখলেন, “এমনিই আর কী! অরুণ, অন্বেষা আর এই সংসার সব কিছু সামলে উঠে গানটাকে আর সময় দেয়া হয়ে ওঠেনি।”
তারপর ঐশ্বর্য্যদার আর কোন রিপ্লাই নেই।
.
দুইদিন পর হঠাৎ করে ঐশ্বর্য্যদার মেসেজ এলো, “একটা ইভেন্টে একটু গান গেয়ে দিবি অনুপ্রভা?”
কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলো অনুপ্রভা। নিজেকে সামলে নিয়ে লিখলেন,
“এতবছর পর কি আর সেই গানের গলা আছে ঐশ্বর্য্যদা! কতকাল রেওয়াজ করা হয় না আর এখন নতুন করে শেখার না আছে বয়স, না আছে সময়।”
“আর ইচ্ছা? ইচ্ছাও কি নেই তোর?”
অনুপ্রভা আর কিছু বলতে পারলেন না।
.
দুই মাস দেখতে দেখতে চলে গেল। ঐশ্বর্য্যদার আবদার ফেলতে পারেননি তিনি। সেই গানের ইভেন্টে গান গাবেন বলে ঠিক করেন। হাতে দুই মাসের মতো সময় দিয়েছিলেন ঐশ্বর্য্যদা। রেওয়াজ করে তৈরী হয়ে নেবার জন্যে।
এই সময়টুকুতে প্রতিদিন দুপুরবেলা আগের মতো রেওয়াজ করে করে অনেকটাই আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছেন তিনি।
গান গাওয়ার কথা শুনেই অরুণ যারপরনাই খুশি হয়ে উঠেছিলেন। তবে অন্বেষার চোখে ছিলো অবিশ্বাস। তার এই ব্যাকডেটেড মা স্টেজে উঠে আর দশজনের সামনে যে গান গাইবে এটা যেন তার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে সরে গিয়েছিল সে। ভেবেছিলো হয়তো কোনো পাগলামি, দুদিন বাদে সেরে যাবে!
.
মাসখানেক হয়ে গেল মা আর আগের মতো বার বার জ্বালায় না। বিরক্ত করে না। অন্বেষার তথাকথিত স্পেসে দখল নেবার চেষ্টা করে না। মা কি তবে বদলে গেলো?
আগের মতো টাইমলি খাবার, ধোয়া জামাকাপড়, গোছানো রুম, বাসভাড়া, টিউশন ফি সবই তো পাচ্ছে সে। আগের মতো। কিন্তু সময় মতো সব পেলেও সেই বিরক্তিকর মা টাকেই বড্ড মিস করে অন্বেষা, যে কারণ ছাড়াই বার বার জ্বালাতন করতো তাকে।
তবে কি গান কেড়ে নিচ্ছে মাকে আমার কাছ থেকে? আমি তো অনেক অবহেলা করি মাকে। এটা সেটা বলে ফেলি। তাহলে কি মা রাগ করে আছে? প্রায় প্রতিদিনই অন্বেষার এরকমটা মনে হয়। আগের মাকে মিস করতে করতে মায়ের সাথে করা প্রতিটি খারাপ ব্যবহারের জন্য প্রচণ্ড অনুশোচনায় ডুবে যেতে লাগলো অন্বেষা।
.
বিকেলে অনুপ্রভার গানের ইভেন্ট। সকাল সকাল উঠেই আরেকবার তাই রেওয়াজ করে নিচ্ছেন।
আজ কলেজ ছুটি। অন্বেষার ঘুম ভাঙলো মায়ের গান শুনে। চুপচাপ উঠে মায়ের পাশে এসে বসলো সে।
গান শেষে অন্বেষা মৃদুস্বরে বললো,
“মা, আজ আমাকে কী নিয়ে যাবে তোমার সাথে?”
অনুপ্রভা কিছু না বলে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। কতগুলো দিন পর মেয়ে আবার সেই ছোট্টবেলার মতো কোথাও যাবার বায়না ধরেছে।
নাহ! মা তো একদম বদলে যায়নি। শুধু নিজের পছন্দকে দাম দিতে শিখেছে।
—————
সেই বিকেলে হলভর্তি মানুষের সামনে গেয়ে উঠলেন অনুপ্রভা,
“পুরানো সেই দিনের কথা
ভুলবি কি রে হায়।
ও সেই চোখে দেখা,
প্রাণের কথা,
সে কি ভোলা যায়…”
গান শেষ হতেই অজস্র করতালির শব্দে ভরে উঠলো চারপাশ।
গান গাওয়ার মাধ্যমে এক নতুন আত্মবিশ্বাসী অনুপ্রভার জন্ম হলো।
সেই সাথে নতুন করে শুরু হলো মা আর মেয়ের পথচলা। পড়ন্ত বিকেল আর গানের প্রতিটি চরণ যেন সেই পুনর্জন্মের সাক্ষী হয়ে রইলো।
(সমাপ্ত)
০ Comments