লেখা: মুন্নি রহমান
চারদিকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লো মালা। ঘরের কাজ সেরে বের হতে হবে ফুল কিনতে। তাড়াতাড়ি না গেলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না আর ফুল তরতাজা না হলে কেউ কিনতে চায় না।
মাথার ওপরে তপ্ত রোদ যেন বিছানা পেতেছে। শরীর আর সায় দিচ্ছে না। সেই সকাল থেকে একগাদা ফুল হাতে এদিক সেদিক দৌড়েঁ বেরুচ্ছে মালা, কিন্তু তেমন বিক্রি হয়নি আজ। হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা হয়ে গেছে তাই একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য রাস্তার পাশে বসে সে। কত মানুষের আনাগোনা রাস্তায়। কত রংয়ের, কত ঢংয়ের মানুষ। এগুলো দেখেই মালার বড় হওয়া, তবুও যেন সাধ মিটে না দেখায়। রাস্তায় সুন্দর পোশাক পরা কাউকে দেখলেই মালার অবাধ্য চোখটা তাকিয়ে থাকে। কখনো কখনও তাকিয়ে থাকার জন্য কটু কথা শুনতে হয় তাকে। ফুল দেওয়ার ছুঁতোয় আবার কখনো ছুঁয়ে দেয় সেই সুন্দরী ললনাদের। তারও এমন সাজতে ইচ্ছে করে। মাথায় রুক্ষ চুল আর গায়ে ছেঁড়া, ময়লা কাপড় না হলে তাকে দেখতে কেমন লাগতো সেই কল্পনায় বিভোর মালা।
” এই যে ফুলওয়ালী তোমার ফুল কত করে?
হঠাৎ কারো কথায় কল্পনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে মালা। সামনে তাকিয়ে দেখলো একজন লম্বা, চওড়া সুন্দর দেখতে ছেলে তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। কল্পনায় এতটাই মত্ত ছিলো যে ছেলেটা কখন আসলো খেয়ালই করলো না সে।
” জ্বে স্যার বিশ টাহা একটা।
” এত দাম কেন?
” স্যার এই দিয়াই সংসার চালাইতে অয়। আব্বার অসুখ কাম করতে পারেনা। আমি আর মায় যে কাম করি হেইয়া দিয়াই আমাগো চলতে অয়।
” ফুল বিক্রি করে আর কত টাকা পাও এতে সংসার চলে? এর চেয়ে অন্য কোন কাজ করলে তো আরো ভালো ইনকাম হয়।
” আর কি কাম করমু স্যার?
” অন্য কত কাজ আছে।
“একবার গেছিলাম এক বড়লোকের বাসায় কাম করতে হেরপর … থাউক স্যার এইসব হুইনা আপনে কি করবেন? কোন ফুলডা নিবেন কন?
” তুমি ব্যস্ত হয়ো না আমার তাড়া নেই। তা তোমার নাম কি?
” মালা।
” তারপর বলো কী হয়েছে কাজ করতে গিয়ে?
” মালিকের একটা জাউরা পোলা আছিলো পোলাডায় কেমনে জানি চাইয়া থাকতো সবসময়। আমি কাম করতে গেলেই খালি চাইরধারে ঘোরতো। একদিন জাপটাইয়া ধরলো, খারাপ কাম করতে চাইলো। তারপর থাইকা আর কোন বাড়ি কাম করতে যাই না। মায়ে যাইতে দেয় না।
” তোমার বাবা কী কাজ করে?
” আব্বায় তো বিছানা থাইকা উঠতে পারেনা, কাম করবো কেমনে?
” আচ্ছা এখন থেকে প্রতিদিন তোমার সব ফুল আমি নিবো । তুমি এখানেই এসো প্রতিদিন কেমন?
” সত্যি স্যার !
” হ্যাঁ সত্যি।
” আইচ্ছা স্যার।
একদিন, দুইদিন, তিনদিন করে কেটে যায় অনেকগুলো দিন। প্রায় প্রতিদিনই কথা হয় আবির-মালার। আবির বড়লোক বাবার ছেলে তাই কাজের পিছনে ছুটতে হয়না। তার অফুরন্ত সময়। আবির তার অফুরন্ত সময়েরই কিছু সময় দেয় মালাকে। মাঝে মাঝে মালাকে নিয়ে ঘুরতেও যায়। মালার খেয়াল রাখে। হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়ায় যেখানে সেখানে। কিন্তু আবিরের এই কেয়ার, দায়িত্ববোধের মধ্যে মালার কিশোরী মনে ভালোবাসার সন্ধান পায়। মালার ছোট্ট মনে ভালোবাসা পাওয়ার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা ফুটে ওঠে। সে এখন আবিরকেই তার স্বপ্ন পুরুষ ভাবে। আবির মালার খুব ছোট ছোট সমস্যা গুলো নিজের মনে করে সমাধান করে। আবিরের সহানুভূতি, ভালোবাসায় মালা ভুলেই গেছে তার আর আবিরের পার্থক্য। ভুলে গেছে সে একজন ফুলওয়ালী।
কাল শনিবার, ১৪ই ফেব্রুয়ারি। পড়াশোনা না করলেও এতদিন ফুল বিক্রি করতে গিয়ে মালা এটা বুঝেছে যে কাল সবাই ভালোবাসার মানুষকে নিজের মনের কথা বলে, তাদের সাথে সময় কাটায়। এতদিন মালা অনেকবার আকার ইঙ্গিতে আবিরকে বোঝাতে চেয়েছে তার মনের কথা কিন্তু আবির বোঝেনি। তাই মালা ঠিক করে কালকেই আবিরকে তার মনের কথা বলবে।
পরদিন খুব ভোরে উঠে মালা নিজেকে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তার তেমন সাজসামগ্রী নাই তবুও যতটুকু পারলো নিজেকে সাজালো। লাল গোলাপের পাপড়ি ঘষে নিজের ঠোঁটে লিপস্টিক লাগালো। আয়নায় বারকয়েক নিজেকে দেখলো মালা। নিজেকে আজ পরিপাটি দেখে নিজের কাছেই ভালো লাগছে। তারপর একগুচ্ছ তাজা গোলাপ নিয়ে চলে গেলো আবিরের সাথে দেখা করতে।
সকাল গড়িয়ে প্রায় দুপুর হতে চললো কিন্তু আবিরের দেখা নাই। মালা ঠাঁয় বসে আছে সেখানেই। অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হওয়ার কথা কিন্তু আশ্চর্য! মালা আজ এতটুকুও বিরক্ত হচ্ছে না। বরং আবিরের জন্য অপেক্ষা করতে ভালোই লাগছে তার। প্রিয়জনের জন্য অপেক্ষাতেও বুঝি সুখ আছে।
অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে আবির আসলো দুপুরের একটু আগে। এসে দেখলো শুকনো মুখে মালা বসে আছে। মালা যে সকাল থেকে কিছু খায়নি সেটা তার শুকনো মুখ দেখেই আবির বুঝতে পারলো।
” সরি সরি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছো? আসলে সবাইকে সময় দিয়ে বেরুতে একটু লেট হয়ে গেলো। চলো আগে খেয়ে নেই তারপর ঘুরতে যাবো আজকে।
” আমি আপনেরে একটা কতা কইবার চাই।
” কথা পরে শুনবো আগে খেয়ে নেই তারপর সব শুনবো।
” না আপনে আগে আমার কতা হুনেন।
” আচ্ছা ঠিক আছে বলো কি বলবে?
” এই নেন এই ফুলগুলা আপনের লাইগা আনছি আমি।
” এই ফুলগুলা বিক্রি করলে তুমি টাকা পাবে। আমি ফুল দিয়ে কী করবো?
” না আইজকা আর ফুল বেচুম না।
” তা কী যেন বলতে চাইছিলা বলো?
” আমি আপনেরে ভালোবাসি, আপনেরে ভালো লাগে আমার।
” আমার সত্যি খুব ক্ষুদা লাগছে মালা। চলো খেয়ে নেই। এসব মজা তারপর করবা এখন মজা করার মুড নাই।
” গরীবরা ভালোবাসা নিয়া কোনদিন মজা করবার পারে না। গরীবের মন একবার যারে ভালোবাসে তারে কোনদিন ভোলে না।
” তোমার মাথা ঠিক আছে? এসব কী বলো?
” আমি আগেই কইতে চাইছিলাম কিন্তু ভয়ে কইনাই কিন্তু আইজকা আর না কইয়া পারলাম না।
” তোমার তো সাহস কম না মালা। তুমি কোন সাহসে আমাকে ভালোবাসার কথা বলো? নিজেকে কখনো আয়নায় দেখেছো? অবশ্য ঘরে আয়না থাকলে তো দেখবে;
” আপনেও আমারে ভালোবাসেন আমি জানি। ভালো না বাসলে আমার এত খেয়াল রাখেন ক্যান? ভালো না বাসলে কেউ বুঝি এত খেয়াল রাহে?
” মানুষ তো রাস্তার কুকুরের ও খেয়াল রাখে তাই বলে কি কুকুরকেও ভালোবাসে? তোমাদের মতো মানুষকে দয়া করা যায়, করুনা করা যায় কিন্তু ভালোবাসা যায় না। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখো কী আছে তোমার? গায়ের জামাটা পর্যন্ত আমার দেওয়া।
মালা অবাক চোখে আবিরের দিকে তাকায়। তারপর নিজের দিকে তাকায়। আসলেই ও কি কুকুরের মতো দেখতে? ও তো মানুষের মতোই দেখতে তবে আবির কেন কুকুরের সাথে ওর তুলনা করলো? ভাবতেই দু’চোখ ভেঙ্গে কয়েক ফোঁটা নোনা জল চিবুক স্পর্শ করলো। নিমিষেই বুকের মধ্যে থাকা স্বপ্নের প্রদীপ দপ করে নিভে গেলো। মূহুর্তেই মালার দেওয়া একগুচ্ছ গোলাপ আবিরের পায়ের তলায় পিষে যায় সেই সাথে পিষে যায় মালার কিশোরী মনে আবিরের জন্য থাকা আবেগ অনুভূতি, ভালোবাসা। আবির চলে যায়। মালার জন্য রেখে যায় অনুতাপ আর ভর্ৎসনা। একবারও পিছনে ফিরে তাকায় না। মালা তাকিয়ে আছে সেই পথে যে পথে আবির চলে গেছে। মালার হৃদয় এক অনুভূতি শূন্য গভীর খাদের সৃষ্টি হয়েছে। এতদিনের মায়া, ভালোবাসা সব কিছু নিমিষেই শেষ হয়ে গেলো। মিথ্যা হয়ে গেলো সব অনুভুতি।
০ Comments